শতবর্ষে তেনজিং
সবার ওপরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরকালীন তা সে জীবনের ক্ষেত্রেই হোক কি প্রকৃতির দুনিয়াই হোক না কেনো। 1852 সালে রাধানাথ শিকদার অংক কষে নির্ধারণ করেন ওই পাহাড় চূড়া উচ্চতা 29,028 ফিট- পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দু 13 বছর পরে 1865 সালে ঐ শৃঙ্গ টি নামকরণ করা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। সেদিন থেকেই অ্যাডভেঞ্চারে নেশায় মত্ত পর্বত প্রেমীদের দৃষ্টি সেদিকে। 1921 সাল থেকে একের পর এক অভিযান হয়েছে। ওই শীর্ষ শিখরে পৌঁছানোর জন্য ব্যর্থ হয়েছে প্রতিটি অভিযান । হিমালয় কেড়ে নিয়েছে বেশকিছু দুঃসাহসিক প্রাণ। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ 29 শে মে 1953। অভিযাত্রী পৌঁছে গেলেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় মানুষ পায়ে হেঁটে উঠল পৃথিবীর শীর্ষবিন্দুতে।
হান্টের নেতৃত্বে 400 জনেরও বেশি সদস্যের ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল এভারেস্ট আরোহণ উদ্দেশ্যে বেস ক্যাম্প স্থাপন করল 1953 এর মার্চে। নানা বাধা বিপত্তি কাটিয়ে দলটি 25,900 ফিট উচ্চতায় এভারেস্টের সাউথ কলে চূড়ান্ত ক্যাম্প তৈরি করে এরপরে আরোহনের শেষ পর্ব।
ছাব্বিশে মেয়ে ওই দলের দুজন সদস্য বোডিলন এবং ইভান্স শিখরে পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তারপরেই দলনেতা হান্ট নির্দেশ দিলেন যে পরবর্তী দুই অভিযাত্রী তেনজিং এবং হিলারি এবার পৃথিবীর শীর্ষবিন্দু উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন।
প্রবল তুষারপাত এবং দুরন্ত বাতাস এই দুটি জুটিকে দুদিন আটকে রাখল সাউথ কলেজ 28 তারিখ আবহাওয়া উন্নীত হওয়ার পর ওরা যাত্রা শুরু করল। সঙ্গে রইল আং লিমা , আলফ্রেড গ্রেগোরি এবং জর্জ লো। সেদিন ওরা 27,900 ফিট উচ্চতায় তাবু ফেললেন। 3 সহকারি ফিরে গেলেন আগের ক্যাম্পে পরের দিন সকালে যাত্রা শুরুর মুখেই বিপত্তি। হিলারির জুতো জোড়া ঠান্ডা ও বরফের আক্রমণে শক্ত হয়ে রয়েছে ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টার পরে হিলারি জুতোতে পা গলা তে পারলেন। তারপরে দুজনে যাত্রা শুরু হলো শেষ এগারোশো ফিট উচ্চতার বাধা অতিক্রম করার জন্য।
এই এগারোশো ফিটের মধ্যে রয়েছে চল্লিশ ফিটের এক পাথুরে দেওয়াল। ভয়ঙ্কর এই চড়াইটি প্রথমে অতিক্রম করলেন হিলারি। তাকে অনুসরণ করলেন তেনজিং । পরবর্তী সময়ে এই পাথরে প্রাচীরটি নামকরণ হয়েছিল হিলারি স্টেপ।
হিলারি স্টেপ এর পরবর্তী অংশ অপেক্ষাকৃত সহজ । সকাল ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় পৃথিবীর শীর্ষবিন্দু মাউন্ট এভারেস্টের বিশ্বে প্রথম পৌঁছালেন পৃথিবীবাসী প্রতিনিধি হিলারি এবং তেনজিং নরগে।
প্রথম এভারেস্ট আরোহণ 60 বছর অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। এভারেস্ট অভিযান শুরু হবার পর প্রথম 32 বছরে কোন মানুষ পৌঁছাতে পারেনি। ওই শীর্ষবিন্দুতে কিন্তু তেনজিং হিলারি সাফল্যের পর 61 বছরের চার হাজারেরও বেশি অভিযাত্রী কমবেশি 7000 পৌঁছেছেন সেখানে । কিন্তু প্রথম সেই জুটি সাফল্যের স্মৃতি কেউ বিস্মৃত হবেন না। আর সেই জুটি অন্যতম সদস্য তেনজিং এ বছর অতিক্রম করেছেন শতবর্ষের সীমারেখা।
হিমালয়ের কোলে নেপালের একটি গ্রাম খুম্বু। ওই গ্রামের চমরি পালক ঘাংলা সিংমা ও তার স্ত্রী ডোকমো কিনজম এর মোট তেরটি সন্তানের একাদশতম পুত্রের আমাদের নায়ক তেনজিং নোরগে। জন্মের তার নাম দেওয়া হয়েছিল নামগিয়াল ওয়াংদির পরিবর্তে তার নাম রাখা হয় তেনজিং নোরগে।
যদিও আমরা 2014 কে তেনজিং এর জন্মশতবর্ষ হিসেবে ধরছি কিন্তু সেই বিষয়ে কিছু বিতর্ক থেকেই যায় । তিব্বতি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তেনজিং এর জন্ম খরগোশ বর্ষে আনুমানিকভাবে যা হয় 1914 আবহাওয়া এবং ফসলের উৎপাদনকে সময়ে মাপকাঠিতে ধরে। তেনজিং শুনেছিলেন তার জন্ম মে মাসে শেষভাগে। এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণের পর ওই তারিখ 29 শে মে তার জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
শেরপা পরিবারে জন্ম তেনজিং এর। শেরপারা হল হিমালয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর উপজাতি । পাহাড় চড়ার দক্ষতার জন্য হিমালয় অভিযানের মালবাহক শব্দটির সমর্থক হয়ে গেছে শেরপা। তেনজিং শৈশবে একবার পাঠানো হয়েছিল থেংবোচে গুম্ফা সন্ন্যাসী হবার জন্য কিন্তু যার ভবিতব্য রয়েছে পাহাড়ের শিখরে শিখরে সেকি মঠের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে পারে? তেনজিং ওই গুম্ফা তে বেশিদিন থাকেননি কিশোর বয়সে দু-দুবার বাড়ি থেকেও পালিয়েছিলেন তেনজিং।
19 বছর বয়সে তেনজিং পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন দার্জিলিঙে। 1935 এরিক শিপপন নেতৃত্বে এভারেস্ট অভিযানের দলে মাল বাহক হিসাবে সুযোগ পেলেন তিনি। সেই শুরু। এরপর একের পর এক অভিযানে অংশ নিয়ে মাল বাহক থেকে অভিযাত্রী দলের নিয়মিত সদস্য হিসাবে উত্তীর্ণ হলেন তেনজিং একাধিক এভারেস্ট অভিযান সহ হিমালয়ের অনেক শৃঙ্গ অভিযান অংশ নিলেন তিনি। 1947 গাড়োয়াল এ কেদারনাথ এর প্রথম সফল শৃঙ্গ আরোহন।
1952 তে দু দুটি এভারেস্ট অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তেনজিং-এর পৌঁছে গিয়েছিলেন সাফল্যের প্রায় দোরগোড়ায় 28 শে মে তেনজিং এবং রেমন্ড ল্যামবাট এভারেস্ট 28,200 ফিট উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। সে বছর শরৎকালের অভিযানে 26,575 ফিট পৌঁছানোর পর খারাপ আবহাওয়ার জন্য ফিরে এসেছিলেন তেনজিং।
অবশেষে সাফল্য এল পরের বছর। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে সেই তারিখ সেই সময়টি সকাল 11:30, 29শে মে, 1953 এভারেস্টের শীর্ষে তেনজিং হিলারি।
সেদিন তেনজিং হিলারি জুটি পৃথিবীর শীর্ষবিন্দুতে কাটিয়েছিলেন প্রায় 15 মিনিট। হিলারির ক্যামেরায় উঠল তেনজিং-এর ফটো। পৃথিবীর শীর্ষবিন্দুতে দাঁড়িয়ে হিলারির কিন্তু কোনো ছবি নেই। তেনজিং চেয়েছিলেন হিলারির ক্যামেরা দিয়ে তার একটা ছবি তুলতে কিন্তু হিলারি রাজি হননি।
আর একটি প্রশ্নের জবাব ওরা কোনদিন দেননি দুজনের মধ্যে কে প্রথম পৌঁছে ছিলেন শীর্ষবিন্দুতে। ওদের হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন দলনেতা কর্নেল হান্ট ওরা একসঙ্গেই পৌঁছেছিলেন একটা দল হিসাবে। পরবর্তী সময়ে অসমর্থিত তথ্যের শোনা যায় দুজনেই নাকি ভিন্ন সময়ে বলেছেন তার সহযোগী প্রথম পদার্পণ করেন শীর্ষবিন্দুতে।
এভারেস্ট আরোহণ এরপর পর তেনজিং পেয়েছেন অজস্র সম্মান। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে দিয়েছিলেন জর্জ পদক। পেয়েছিলেন তিনি পদ্মভূষণ খেতাব। নেপাল সরকার তাকে দিয়েছিলেন নেপাল তারা নেপাল ভারদাক। দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রথম ডিরেক্টর হয়েছিলেন তেনজিং।
1985, 9ই মে দার্জিলিঙে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তেনজিং।
এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন তেনজিং। তার এবং হিলারির পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাজার হাজার অভিযাত্রী পৌঁছে যাচ্ছেন ওই শীর্ষবিন্দুতে। ওরা কেউ কিন্তু এভারেস্ট জয় করছে না। তেনজিং এর ভাইপো নোয়াং গোম্বুর কথায় ” শৃঙ্গ কখনো জয় করা যায় না বড়জোর শৃঙ্গে পৌঁছানো যায়। আমরা পাহাড়ে উঠে তীর্থ করতে তীর্থক্ষেত্রে সবাই যেভাবে পুজো দিতে যায় আমরা সেভাবেই যাই। পাহাড় কে শ্রদ্ধা জানাই।”
এভারেস্টের তীর্থ এ প্রধান পূজারী তেনজিং নরগে কে আমাদের প্রণাম।