ঘুরতে যেতে কে না ভালোবাসে? পাহাড় জঙ্গল ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা কিন্তু এবারে ঠিক হল পাহাড় নয় যাব জঙ্গলে ঘুরতে । সেইমতো পছন্দের ট্রেন কাঞ্চনকন্যা আমরা উঠে পড়লাম সকাল সকাল পৌঁছেগলাম নিউ মাল জংশন। আগে থেকে যেহেতু গাড়ি ঠিক করা ছিল না তাই নেমে গাড়ির খোঁজ করতে শুরু করলাম। একের পর এক ড্রাইভার এর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিলাম। একটি ড্রাইভার ঠিক করে বসে পড়লাম সেই গাড়িতে । প্রথমেই বলে রাখি , যাত্রাপথে যদি আপনার ড্রাইভার মনের মত না হয় তাহলে সে ঘোরা অর্ধেক আনন্দ মাটি হয়ে যায়। তো এই যাত্রায় আমাদের একটু ভালই ড্রাইভার পেয়েছিলাম। সকাল থেকে আকাশ এত পরিষ্কার যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঠাকুরগঞ্জ নামক জায়গা থেকেই তাঁর দর্শন পেয়ে গেলাম। একটা দারুণ ওয়েদার ছিল । নিউ মাল জংশন কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ শহর । ১৯৪৭ সালের আগে এটি একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। বর্তমানে এখানে নিউ জলপাইগুড়ি শামুকতলা রোড ও নিউ মাল চাংরাবান্ধা – কুচবিহার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করে । এর পূর্ব দিকে পরে ঠিক সাত কিলোমিটার দূরে ডামডিম থেকে আপনি লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ কোলাখাম এর দিকে যেতে পারবেন। আবার আপনি চাইলে বিপরীত দিকে ৯ লিমিটেড যদি যান , তাহলে পৌঁছে যাবেন সামসিং সানতালখোলা, মৌচুকি, রকি আইল্যান্ড। আরো ছয় কিলোমিটার এগোলে এখানে এসে পৌঁছে যাবেন খুনিয়া মোড়ে। এখান থেকে সাত কিলোমিটার উত্তরে মূর্তি এবং দক্ষিণ দিকে চাপড়ামারি জঙ্গল হয়ে চলে যেতে পারেন কোমায় ঝালং ও বিন্দুতে। আমরা নিউ মাল বাজারে একটি দোকান থেকে কিছু জলখাবার খেয়ে নিয়ে রওনা হলাম মুহূর্তের উদ্দেশ্যে। তার আগে অবশ্য সেবক ব্রিজ এর ফাঁকফোকর দিয়ে ক্যামেরাবন্দি করে নিয়েছি তিস্তার কিছু মনোরম দৃশ্য।
চালশা খুনিয়া মূর্তির 15 কিমি জঙ্গলের রাস্তা অতিক্রম করে এসে উঠেছিলাম গরুমারা নেচার কটেজে নামে গরুমারা থাকলেও এটা মূর্তি তে অবস্থিত প্রথম দর্শনে আপনাদের অবশ্যই মন জয় করে নেবে। ফুলে পরিপূর্ণ বাগান সামনে দিয়ে তরতর করে বেড়ে চলেছে মূর্তি নদী । এটি নেওড়া ভ্যালি পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে গরুমারাতে জলঢাকাতে মিশেছে। আর এই নদীটি ডুয়ার্সের জঙ্গল গরুমারা ও চাপড়ামারি জঙ্গল কে আলাদা করেছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঠিক করলাম রঙ্গ ঘুরে আসব। রঙ্গ একটি নতুন জায়গা। প্রধানত এটি রঙ্গ জঙ্গল নামে পরিচিত। আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রংগের উদ্দেশ্যে। আপার তেন্দু চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। তারপরেই গাড়ি ঢুকে পড়লো চাপড়ামারি জঙ্গলে । আমরা উৎসুক ভাবে জানলা দিয়ে তখন তাকিয়ে আছি যদি কিছু দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই দুপুর বেলায় কি আর দেখা যাবে? তারা নিশ্চয়ই দিবা নিদ্রায় মগ্ন । একে একে চাপরামারি ফরেস্ট বাংলো, দর্শন মিনার, ছাড়িয়ে রবার গাছের বন অতিক্রম করে কুমাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঝালং রাস্তা ধরে এগিয়ে চলতে থাকলাম। ঝালং যাওয়ার আগে পরে গৈরি বাস ভিউ পয়েন্ট । ওখানে একটা ধাবাতে দুপুরের খাবার তখন আমরা খেয়ে নিলাম। নীচে আবার একটা লাভারস পয়েন্ট আছে । যার নিচ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী। নদীর পিছনেই পড়ে ভুটানের পাহাড়শ্রেণী। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনারা ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলবেন না। কম খরচে তৃপ্তি করে বেশ খাওয়ার পাওয়া যায় এখানে। তারপরে এগিয়ে চললাম রংগোর দিকে। আর পাঁচটা গ্রামের মতন রাস্তার পাশে বাড়ি ঘর । দলগাঁও হয়ে এসে পৌছালাম রঙ্গ বাজারের কাছে। এখানে দু-একটা হোমস্টে গড়ে উঠেছে। একজন স্থানীয় লোক আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল রঙ্গ ভিউ পয়েন্ট এর দিকে ।পাইনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। বেশ কিছুটা যাবার পর এসে পৌছালাম ভিউ পয়েন্ট সামনে। দিগন্তবিস্তৃত জলঢাকা নদীর বিস্তার বাঁদিকে ভুটানের পাহাড়, ডানদিকে সানতালখোলা আর পাহাড়ের পিছনে রকি আইল্যান্ড বিকেলের দৃশ্য পরিষ্কার নয় এবার ফেরার পালা । তার আগে ঘুরে দেখলাম নেওড়া হাইড্রল প্রজেক্ট । জলঢাকা নদীর ওপর এই প্রজেক্ট। বর্ষাকালে এরূপ অপূর্ব সুন্দর হয় যদি আপনারা এখানে আসতেই চান তাহলে অবশ্যই বর্ষা দিকে আসবেন । কারণ ডুয়ার্সে সৌন্দর্য সবসময় বর্ষাকালে অপরূপ। না হলে ডুয়ার্স কতটা সুন্দর সেটা অন্য সময় এলে বুঝতেই পারবেন না। ফেরার পথে দেখতে পেলাম এক লেভেল ক্রসিং । সামনে দিয়ে চলে গেল আলিপুরদুয়ার জংশন নিউ জলপাইগুড়ি টুরিস্ট ট্রেন। সামনে-পিছনে দুটি ভিস্টাডাম কোচ। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি পথ ধরে ফিরে চলে এলাম আমাদের রিসোর্টে। তখন ভীষণ ক্লান্ত আচ্ছন্ন রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার শ্বেতশুভ্র পর্বত শৃঙ্গ টি চোখে পড়ল হতে পারে এটি পান্ডিম পর্বতের চূড়া। নদীর চরে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম মূর্তি ব্রিজে একটু ঘুরাঘুরি করে সামনের দোকান থেকেই খেলাম এবং চাপড়ামারি জঙ্গলে একটু অনধিকার প্রবেশ করে ঘুরে আসার মধ্যেই আজকে সকাল সীমাবদ্ধ থাকলো। সকাল নটার দিকে গাড়িতে উঠে পড়লাম প্রথমে চলে গেলাম চালসা মোড়। তার পরে সেখান থেকে পৌঁছে গেলাম সামসিং, সানতালখোলা ,রকি আইল্যান্ড। আমাদের গাড়ি এসে থামল লালিগুরাস ভিউ পয়েন্ট । আমাদের জন্য এক নতুন জায়গা। পাহাড়ের ওপরে এর অবস্থান ঠিক যেন একটা চাতাল মতন। একদিকে চা বাগান অন্যদিকে গভীর গিরিখাত দিয়ে বয়ে চলেছে মূর্তি নদী নদীর পাড়ে সাজানো-গোছানো পিকনিক স্পট এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ছবি তুলে এগিয়ে চললাম ৪ কিলোমিটার দূরে রকি আইল্যান্ড ।এখানে মূর্তি পাথরের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে প্রবাহিত। কিছুটা জায়গা সমতলের মতন ।নদীর ওপর দিয়ে পাকা ব্রিজ ও সড়কপথ আর এই সড়কপথ গিয়ে শেষ হয়েছে বিন্দুতে। বেশ কয়েকটা দোকান চোখে পড়ল । এরপর এগিয়ে চললাম সান্তালখোলার দিকে। কিন্তু ভিউ পয়েন্ট অর্থাৎ ঝুলন্ত সেতু অব্দি যেতে গেলে অন্য গাড়ি নিয়ে যেতে হবে আর না হলে পায়ে হেঁটে আপনাকে যেতে হবে 11 কিলোমিটার মত। জনপ্রতি কুড়ি টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঝুলন্ত সেতুতে দুলতে দুলতে উপরে উঠতে থাকলাম। ঝুলন্ত সেতু রাস্তাটি অসাধারণ বড় বড় গাছের ছায়ায় আলো-আঁধারি যেন খেলা চলছে। দুপুরে খাওয়া শেষ করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম এক নদীর চরে উদ্দেশ্যে । বিশাল সেই চর। মাঝে মাঝে বয়ে চলেছে নদীর কিছু ধারা। নদীর অন্যপ্রান্তে জঙ্গল সেখান থেকে হরিণ ময়ূর ইত্যাদি বের হয়ে বিচরণ করে। অবশ্য একদল ময়ূরের ও আমরা দেখা পেলাম। সন্ধ্যায় জঙ্গলের পথে শিহরণ জাগিয়ে আবার ফিরে এলাম হোটেলে আমাদের মূর্তি ভ্রমণ এখানেই শেষ করলাম তারপরে পর্বে আপনাদেরকে জানাবো সিসা মারার উদ্দেশ্যে গিয়ে কি কি করলাম।