রামায়ণের মহীরাবণ পূজিত “ভদ্রকালী ” পাতালথেকে মর্ত্যে এখানে এসে ” যোগদ্যা” নামে রয়ে গেছেন ৷ “জলে মা যোগদ্যার বাস বারো মাস ৷” বৈশাখ সংক্রান্তিতে বিশেষ পুজোর সময় জল থেকে উঠে ভক্তদের দর্শন দেন ৷ আজ আবার মা যোগদ্যাকে দর্শন করে এলাম ৷দুপুরে হঠাৎ গিয়েও পেলাম প্রসাদ ৷কাটোয়া থেকে ২১ আর বর্ধমান থেকে ৪০ কিমি দূরে কৈচরের কাছে মঙ্গলকোট থানার এই ক্ষীরগ্রাম ৷ ভৈরব ক্ষীরকন্টকের নাম থেকে জায়গার নাম ক্ষীরগাঁবা ক্ষীরগ্রাম ৷কাটোয়ায় মহকুমায় রয়েছে চারটি “সতীপীঠ ” ৷ ক্ষীরগ্রাম , কেতুগ্রাম , কোগ্রাম ও অট্টহাস ৷ সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় মা যুগাদ্যা বা যোগদ্যা ৷ এখানে সতীর ডান পায়ের আঙুলপড়েছিল ৷ পাথরের তৈরী সিংহবাহিণী দশভূজা মহিষমর্দ্দিনী মূর্তি ৷ অঞ্জলিবদ্ধ হাত ৷ যা দেখেই বোঝা যায় ইনি মহীরাবণ পূজিত উগ্রচন্ডা ভদ্রকালী ৷ এই যোগাদ্যা নিয়ে অন্ততঃ সত্তরটি প্রাচীন পুঁথি পাওয়া গেছে ৷কবি ভারতচন্দ্র “অন্নদামঙ্গলে “লিখেছেন ” ক্ষীরগ্রামে ডানিপার অঙ্গুটবৈভব ৷ যোগাদ্যা দেবতা ক্ষীরকন্টক ভৈরব” ৷ষষ্ঠ শতকের কুব্জিকা তন্ত্রে ক্ষীরগ্রামকে সিদ্ধপীঠ আখ্যা দিয়ে লেখা হয়েছে ,” ক্ষীরগ্রামং বৈদ্যনাথং জানীয়াদ বামলোচনে ৷ কামরূপং মহাপীঠং সর্বকামফলপ্রদম্ “৷ বৃহৎ নীলতন্ত্র লিখছে ,” ক্ষীরপীঠে যুগাদ্যা চ ক্ষীরাখ্যা নিয়মপ্রভা ৷ রাজেশ্বরী মহালক্ষ্মী হস্তিনাপুরবাসিনী “৷ এখানকার যোগাদ্যার উল্লেখ দেখেছি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও রামানন্দ যতির চন্ডীমঙ্গলে , মানিকরাম , রূপরাম ও ঘনরামের ” ধর্মমঙ্গলে ” , বলরাম চক্রবর্তীর “কালিকামঙ্গলে ” , কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের “মনসামঙ্গলে ও কৃত্তিবাসের ” রামায়ণে ” ৷এছাড়াবাঞ্ছারাম ভট্টাচার্য ও দয়ারামের ” যোগদ্যা বন্দনা”তেও দেবীর কথা আছে ৷ গ্রামের মাঝখানে দেবীর মন্দির পত্রিশ ফুট উঁচু গর্ভগৃহ ৷ ক্ষীরখন্টক ছাড়াও ক্ষীরগ্রামকে রক্ষার জন্য আছেন চারজন ভৈরব- গিধগ্রামে ” গিধেশ্বর “, (পূর্বে) , পশ্চিমে নিগনে “লিঙ্গেশ্বর “, উত্তরে শীতলগ্রামে ” শীতলেশ্বর “এবং দক্ষিণে পুইনা- পলাশিতে ” পাতালেশ্বর “শিব ৷নিত্য পুজো হলেও ক্ষীরগ্রামে বার্ষিক উৎসবশুরু হয় ১৫ বৈশাখ বিকাল থেকে ঐদিন থেকে উৎসব পর্যন্ত ঢাকের বদলে মন্দিরে মাদল বাজে ! এছাড়া মাঘমাসে রাতে চোখ কাপড় দিয়ে ঢেকে এখানকার বৃত্তিধারী( সারাবছর যাঁরা ঢাক বাজান ) ঢাকিরা “নিশিধম্বল” অনুষ্ঠানে ঢাক বাজান ৷ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা থাকায় কোন “দুর্গাপুজো” হয়না ৷ বৈশাখী উৎসব শুরু হয় পান সুপারী দিয়ে “গুয়াডাকা” র মধ্য দিয়ে ৷সারা বৈশাখ মাস এই গ্রামের মানুষভাতের হাঁড়িতে কাঠি দেয়না , চাল করে না , লাঙ্গলদেয়না , হলুদ বাঁটে না ৷ এমনকি পূর্ণগর্ভা নারীদের অন্যত্র পাঠানো হয় ৷ গ্রামে রাখা হয়না ৷ক্ষীরগ্রামের ঠাকুরবাড়ীর বউ আমার পিসিমার কাছে শুনেছি আগে কালোকালিতে স্থানীয় মানুষ চিঠি লিখতেন না ৷লাল কালিতে লিখতেন ৷৩০ বৈশাখ হয় “হল লাঙ্গল” অনুষ্ঠান ৷১৫-৩০ বৈশাখ মায়ের নামেরোজ গ্রাম প্রদক্ষিণ চলে ৷ ঢাকিরাই নিষেধ থাকায় মহাপুজোয় ঢাকের বদলে মাদল বাজায় ৷ এই অনুষ্ঠানে হয় ” ডোম চুয়াড়ি ” ও ” নদের মশাল “প্রথা পালন ৷পাটুলী , নদীয়া , বর্ধমানের রাজা ও বহু জমিদাররা এই পুজোর সাথে যুক্ত থাকতেন ৷ক্ষীরগ্রামে পুজো দিতে এসে অনেক আগে কোন কোন জায়গার ভক্তরা নিজেরা পথ আগলে রাখতো ৷ শান্তিপুরের আশানন্দ ঢেঁকি তা রদ করেন ৷আগে নররক্ত ছাড়া পুজো হত না ৷ পরে তা বন্ধ হয় ৷ জনশ্রুতি আছে যে এককালে নাকি নরবলি প্রথার প্রচলন ছিল দেবী যোগাদ্যার স্থানে | প্রতিবছর বাৎসরিক পূজার দিন নিয়ম করে গ্রামেরই একজন করে মানুষ বলি দেওয়া হতো দেবীর সামনে এক এক বছর সেই পালা পরতো এক এক জন গ্রামবাসীর উপর |এখনও অসংখ্য বলি হয় ৷ মহিষ বলিও হয় ৷ দেবী কালী মন্ত্রে পূজিত হন ৷ সেবাইতরা আত্মীয় হওয়ায় প্রচুর ভীড়ের মধ্যে ও পুজোর সমস্ত খুঁটিনাটি কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ৷ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা বাণীপীঠের প্রত্নশালায় এখানে পাওয়া অনেক দুর্লভ প্রত্নদ্রব্য রাখা আছে ৷ দেখে নিতে পারেন ৷ নরবলির ইতিহাস দেখা যায় ” মোরনাচে “!হনুমানের আনা মহীরাবণের উপাস্য দেবী ভদ্রকালী বা মা যোগাদ্যাকে দেখতে চলে আসুন। মূল অনুষ্ঠান হবে বৈশাখ সংক্রান্তিতে ৷” মাথায় প্রতিমা করি আন্যা হনুমানঅবনি মন্ডল মধ্যে ক্ষীরগ্রাম নাম ৷”এখানকার শাঁখারীর মায়ের হাতে শাঁখা পরানো লিখে গেছেন বাঙালি ইংরেজি কবি তরু দত্ত” Ancient Ballads and legends of Hindustan’বইয়ে ” Jogadya uma ” কবিতায় ৷ তাঁর এই মাহাত্ম বন্দনা ছন্দের জাদুকর ” সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত” অনুবাদ করেছেন -” সকাল বেলাতে শাঁখারী চলেছে হেঁকে ,/ শাঁখা চাই ভাল শাঁখা , চাই ভাল শাঁখা !/ … দেখি মা তোমার হাত – / কৌতুকভরে হস্ত বাড়াল নারী ….. সহসা শঙ্খবলয়িত কার পাণিজাগিয়া উঠিল পদ্ম দীঘির বুকে ” ! যিনি স্বয়ং মা যোগাদ্যা !
অর্গলাস্তোত্রের দ্বিতীয় শ্লোকে দেবীর এগারোটি রূপের মধ্যে চতুর্থ হলেন “ভদ্রকালী” ৷ এখানে “ভদ্র” মানে মঙ্গলজনক বা কল্যাণময়ী আর কাল অর্থে শেষ সময় ৷যিনি মৃত্যুর সময় জীবের মঙ্গল সাধন করেন ৷সাধককে অভীষ্টফল দেন ৷ ইনিই রূপান্তরে মহিষমর্দ্দিনী ৷তাই , দুর্গা পুজোয় আমরা মন্ত্র পড়ি ,” ওঁ হ্রীং ভদ্রকাল্যৈ নমঃ”৷ শ্রীশ্রীচন্ডী ও মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুসারে দেবী ভদ্রকালী রূপে মহিষমর্দ্দন করেন ৷ইনি কালীর একটি রূপ ৷মহাভারতে এই দেবী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে জয়প্রদায়িনী ৷ এজন্য অনেকে মনে করেন দাক্ষায়নী সতীর ডান পায়ের গোড়ালী কুরুক্ষেত্রে পড়েছিল ৷সেখানে ভৈরব হলেন থানেশ্বর মহাদেব ৷কোন কোন জায়গায় ভদ্রকালীকে সরস্বতীর সাথে অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে ৷
কালিকাপুরাণে দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের মত , মাথায় জটা , কপালে অর্ধচন্দ্র ও গলায় কন্ঠহার ৷ তবে , তন্ত্রাচারে তিনি ঘোর কালো , মুক্তকেশী , কোটরাক্ষী , দাঁতগুলো কালো ,মলিনা ,ক্রন্দনরতা ও ক্ষুধিতা যিনি জগৎকে গ্রাস করবেন বলে চিৎকাররতা ৷ হাতে তাঁর জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ৷তবে , বাল্মীকির রামায়ণ অনুসারে দেবী পাতালপুরীর রাক্ষসরাজ মহীরাবণের আরাধ্যা “ভদ্রকালী” ৷ এই রূপেই তিনি বাংলায় আদৃত ৷ অনেক জায়গায় পূজিতা ৷ ক্ষীরগ্রামের বর্তমান সুন্দর দেবী প্রতিমাটি দাঁইহাটের নবীন ভাস্করের তৈরী ৷মন্দিরের সামনে পরে নবীন ভাস্করেরও মূর্তি করা হয়েছে ৷মন্দিরের পুকুরে রয়েছে বিশালাকার প্রচুর মাছ ৷ হাতে করে খাবার দিলে খেয়ে যায় ৷পাতাল থেকে এনে এই দেবীকে রামচন্দ্র অকালবোধন অর্থাৎ শারদীয় দুর্গাপূজা করেন ৷রামায়ণ অনুসারে রাম ও লক্ষ্মণকে লঙ্কা থেকে ধরে এনে পাতালপুরীতে তাঁর আরাধ্যা দেবী ভদ্রকালীর কাছে বলি দিতে নিয়ে যায় মহীরাবণ ৷তার ইচ্ছা ছিল রাম -লক্ষ্মণ যখন দেবীকে প্রণাম করবেন তখন দেবীর পিছনে রাখা খাঁড়া দিয়ে দুই ভাইকে বলি দেবে ৷ কিন্তু , হনুমানের বুদ্ধিতে রাম লক্ষ্মণের বদলে মহীরাবণই বধ হয় ৷রামের ইচ্ছায় হনুমান দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসে বর্ধমানের সতীপীঠ কাটোয়া সন্নিকটস্থ ক্ষীরগ্রামে মা যোগদ্যা রূপেপ্রতিষ্ঠা করেন ৷ ওখানে পাথরের তৈরী সিংহবাহিণী মূর্তি , অঞ্জলিবদ্ধ হাত বিশেষ পুজো ছাড়া জলে থাকে ৷ দেখে বোঝা যায় মহীরাবণ পূজিতা উগ্রচন্ডা ভদ্রকালী ৷ ক্ষীরগ্রামে সতীর ডান পায়ের আঙুল পরায় তা সতীপীঠ ৷ যাঁর ভৈরব পাশেই ক্ষীরকন্ঠক ৷ কুব্জিকা তন্ত্রে যোগদ্যার কথা আছে ৷ বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় সতীপীঠ এই মা যোগাদ্যার সারা ভারতে যথাযথ প্রচার হোক ৷ গড়ে উঠেছে বড় তীর্থস্থল ,ঘরবাড়ী ৷ কলকাতা থেকে সতীপীঠ দেখানোর বাস চালু হচ্ছে ৷জয় মা যোগাদ্যা।
পথনির্দেশ:- কাটোয়া-বর্ধমান রেলপথে কাটোয়া থেকে ১৭ আর বর্ধমান থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কৈচর স্টেশন। কৈচর স্টেশন থেকে বাস বা রিকশায় কৈচর পৌঁছে সেখান থেকে ক্ষীরগ্রামের পশ্চিমে দেবী যোগাদ্যা মায়ের মন্দির। আপনারা যারা বাইকে বা গাড়িতে আসতে চান, আপনারা গুগল ম্যাপ অন করে সোজা পৌঁছাতে পারেন এই মন্দিরে।