৮০০ খ্রিস্টাব্দে শার্লামেনের সিংহাসন আরোহণের গুরুত্ব

৮০০ খ্রিস্টাব্দে শার্লামেনের সিংহাসন আরোহণের গুরুত্ব

সম্রাট শার্লামেন এর অভিষেক এবং পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের গুরুত্ব মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে একটি সযত্নে বিশ্লেষিত হওয়ার বিষয়। ঐতিহাসিক ব্যারাক্ল অভিষেকের ঘটনাটিকে পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতার সূচনা কাল বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক লর্ড ব্রাইস ঘটনাটিকে মধ্যযুগের ইউরোপের কেন্দ্রীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক ফার্দিনান্দ লট ৮০০ খ্রিস্টাব্দ অভিষেক কে বাতিল হয়ে যাওয়া ধারণার অনুরক্ত কয়েকজন যেমন তেমন করে উপস্থাপিত একটি শূন্যগর্ভ প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা এই দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে শার্লামেনের অভিষেকের গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।

প্রথমত: শার্লামেনের অভিষেক তৎকালীন ইউরোপের নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি অবসান ঘটিয়ে সর্বত্র বিশৃংখলার পরিবর্তে আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের অবসানের পর থেকে প্রশাসন মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল । অভিষিক্ত খ্রিস্টান দুনিয়াকে একত্রিত করে রোমান সাম্রাজ্য কে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং হয়ে ওঠেন রোমের বিশেষ শেষ বিখ্যাত সম্রাট এবং পশ্চিমাঞ্চলের প্রথম শ্রেষ্ঠ সম্রাট।
দ্বিতীয়তঃ বাস্তব ক্ষেত্রে রোমান সাম্রাজ্যের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু সাধারণ বিশ্বাস এবং মানুষের মনে সাম্রাজ্যে ধারণা বিলুপ্ত হয়নি। তাই সাধারন বিশ্বাস অভিষেকের ঘটনা দ্বারা মূর্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ অভিষেক ছিল মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার পরিণতি। রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং জার্মান প্রতিনিধিদের পুনরায় মানুষকে সুবর্ণ যুগ এর স্বাদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

তৃতীয়তঃ অভিষেকের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল জার্মানির ওপর । জার্মান প্রতিনিধির মাধ্যমে ঘটনাটি ঘটলো জার্মান জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বস্তুত এই সময় থেকেই জার্মানরা একটা স্বতন্ত্র জাতির মর্যাদা লাভ করে।

চতুর্থঃ জিও ফ্রে ব্যারাক্ল এর মতে শার্লামেনের সম্রাট প্রাপ্তির গুরুত্ব নিহিত আছে তার বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতদিন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য বজায় রেখেছিল তা ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। এবং ৮০০ খ্রিস্টাব্দ ঘটনার পর পূর্ব রোমান সম্রাটের দাবির অসারত্ব স্পষ্ট হয়। ফ্রাঙ্ক সম্রাট ও পূর্ব রোমান সম্রাট সমমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। ৮১২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব রোমান সম্রাট শার্লামেন কে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দান একটি অখন্ড রোমান সাম্রাজ্যের ধারণার পরিবর্তে ইউরোপ মহাদেশের দুটি সাম্রাজ্যবাদ বা সভ্যতার বিকাশকে সুনিশ্চিত করে।

পঞ্চমতঃ অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত পরিবেশে। অভিষেকের সঙ্গে যুক্ত দলগুলির অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তা দেওয়ার আইনগত অধিকার ছিল না। আর শার্লামেন যা গ্রহণ করেছিলেন তা গ্রহণের অধিকার না থাকলেও তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন । আর এই অস্পষ্ট তার জন্যই পরবর্তীকালে পোপ পন্থীরা সম্রাটের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে সম্রাট পন্থীরা চার্লস কে ঈশ্বরের মনোনীত ব্যক্তি হিসাবে প্রমাণ করেন সুতরাং অভিষেককে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে সম্রাট অপরের মধ্যে অধিকারের লড়াই ইনভেস্টিচার সংগ্রাম শুরু হয়। যা মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম কেন্দ্রীয় ঘটনা।

ষষ্ঠতঃ অভিষেকের পর থেকেই পশ্চিম ইউরোপ বা ল্যাটিন খ্রিস্টান জগত নিজের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। ফলে ইউরোপের পশ্চিম এবং পূর্বাংশের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ইউরোপের রাষ্ট্রনৈতিক বিন্যাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

সপ্তমতঃ শার্লামেনের অভিষেক পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান রোমান ও জার্মান উপাদানগুলির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিল বস্তুত এই ঘটনার পর থেকে বর্বর ও রোমান সংস্কৃতি এই দুটি ভিন্ন ধারার মেলবন্ধনে একটি নবগঠিত সংস্কৃতি সূচনা হয়।

নবমতঃ পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে শার্লামেনের অভিষেক সরাসরি একটি বিজ্ঞানসম্মত এবং নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ঘটায়। চার্লস একটি উন্নত প্রশাসন গড়ে তোলেন যা পরবর্তী শতাব্দীতে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির আদর্শে পরিণত হয়। এছাড়া এই সময় সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ক্রমশ ভূমধ্যসাগর থেকে সরে গিয়ে আল্পসের উত্তর দিকে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রাংক তথা জার্মান উপাদান এর সাহায্যে সাম্রাজ্যের কাঠামো নতুন করে গড়ে ওঠে।

দশমতঃ শার্লামেনের অভিষেক ইউরোপের শান্তি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে রোমান, খ্রিষ্টান, জার্মান সকলে সমবেত হয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি শিল্পের উজ্জীবন ঘটায়। নবম শতাব্দীতে যা ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁ মধ্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। বলা যায় অভিষেক নিঃসন্দেহে আধুনিক চেতনা ও মানসিকতা প্রসার ঘটায়। যদিও শার্লামেনের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। তবুও শিক্ষা সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারাটি দীর্ঘদিন অম্লান থেকে যায়।

কিন্তু উপরিউক্ত তাৎপর্য গুলিকে অস্বীকার না করলেও অভিষেকে তাৎপর্যকে অতিরঞ্জিত করা ঠিক নয় শার্লামেন অভিষেক এর মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপের অধিপতি হয়ে ওঠেননি ইংল্যান্ড স্পেন উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়া তার সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল। এবং বাস্তবের ছিলেন একজন ফ্রাংক রাজা। যিনি ফ্রাংক ভূমি থেকে রাজস্ব আদায় করতেন এবং ফ্রাঙ্ক দের মধ্যে থেকেই তার মন্ত্রী এবং কর্মচারী নিযুক্ত করতেন। শার্লামেনের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল কারণ ফ্রাঙ্ক রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য টিকে থাকত যদি ফ্রাঙ্ক রাজ্যটি দুর্বল না হয়ে শক্তিশালী থাকতো।

অভিষেক একজন জার্মান রাজার কাছে তার সম্রাট মর্যাদা লাভের জন্য পোপের স্বীকৃতিতে একটা মডেল করে তুলেছিল। ফলাফল হল পরবর্তী ৭০০ বছর কোন জার্মানরা চিন্তা করতে পারেননি যে তিনি ইতালি শাসন করবেন না ।জার্মান রাজাদের শক্তি ইতালিতে ব্যয়িত হওয়ায় জার্মানির জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিই উপেক্ষিত হয়ে যায়।
উপসংহারে বলা যায় অভিষেক মধ্যযুগের কেন্দ্রীয় ঘটনা শুধু ছিল না। এর মধ্যে আধুনিক যুগের বহু প্রবনতার পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায়। শার্লামেনের অভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়।

Leave a comment