বর্ণ বৈষম্য থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর মেঘনাদ সাহা অজানা কাহিনী

লোকেরা বলেন নামে কি এসে যায়। এমন কথায় ভুল বলছি না। তবে বাড়ির বড়রা যখন নবজাতকের নাম রাখেন , তা থেকে বড়দের রুচি ও ভাবনায় পরিচয় খানিকটা হলেও পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নাম নিয়ে নানা রকমের কাহিনী রয়েছে । প্রচন্ড ঝড় জলের রাত্রে তার জন্ম হয়েছিল বলে দিদিমা মেঘনাদ নাম রেখেছিলেন। এমন শোনা যায় ঝড় জলের মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই তীব্র বজ্রপাত হচ্ছিল । মেঘনাদ বলতে বোঝায় ‘মেঘের ডাক’ সে হিসাবে এমন নাম রাখার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

মহাকাশ অভিযানের সবচেয়ে বেশি জিনিসপত্র দিয়ে আমেরিকায় তৈরি হয়েছে এক জাদুঘর তার নাম ন্যাশনাল এন্ড এয়ার স্পেস মিউজিয়াম। এই জাদুঘরের সিনিয়র কিউরেটর যিনি, তার নাম ডেভিড ডিভারকিন। প্রচুর পড়াশোনা তার। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাস বলা যায় নখদর্পণে। মেঘনাদ সাহার পুত্র অজিত সাহের কাছে ডিভারকিনা একবার চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, বিজ্ঞানী মেঘনাদ এর নাম কে রেখেছিলেন। অজিত সাহা হাজার ১৯৯০ সালের 14 ই জানুয়ারি ডেবিট কে চিঠি লিখে জানান তার দাদু ঠাকুমা মিলে নাম রেখেছিলেন মেঘনাদ। মেঘনাদ মানে মেঘের দেবতা। মেঘের দেবতা বলতে দেবরাজ ইন্দ্র কে বোঝায়। এমন নাম বড় হয়ে মেঘনাদের পছন্দ হয়নি তখন তিনি নাম বদল করেন।
ভারতের একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন অধ্যাপক জগদিশচন্দ্র ভট্টাচার্য। মেঘনাথ সাহার জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেখানে অধ্যাপক ভট্টাচার্য্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার উপর একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধ বিজ্ঞানীর নাম নিয়ে তিনি যা লিখেছিলেন, বেশ চিত্তাকর্ষক। খানিকটা অংশ অনুবাদ করে দেওয়া যেতে পারে।
” আমাদের মহাকাব্য রামায়ণের কথিত আছে যে মেঘনাদ রাবণের পুত্র। যে দেশের সর্বত্র রাম পূজিত হয়, রামের শত্রুকে কেউ প্রশংসা চোখে দেখে না। অথচ গ্রামের সাধারণ মানুষ বাবা জগন্নাথ সাহা ও মা ভুবনেশ্বরী দেবী তাদের ছেলে এমন নাম রেখেছিলেন। প্রচলিত ঐতিহাসিক ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে এমন কাজ সাহসিকতা ও বিপ্লবী মানসিকতার পরিচয় রাখে। আমার মনে হয় অধ্যাপক সাহা পরিণত জীবনে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন তা তিনি বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।

এই নিবন্ধের লেখক যে যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন তা বলতেই হবে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তথাকথিত রামের জন্মভূমি উদ্ধারের জন্য বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তারপরে বছর ১৯৯৩ সাল ছিল বিজ্ঞানী সাহার জন্মশতবর্ষ। উত্তরপ্রদেশে এক ঠিকানায় সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধুলিস্যাৎ হয়েছে। অন্য ঠিকানায় এমন এক সাহসী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে । বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের তখন ভারতীয় রাজনীতির এক শীর্ষ চরিত্র ছিলেন। জগদীশচন্দ্র নিবন্ধ যে হাত পড়েনি তা আমাদের পুলকিত করেছে । মাইকেল মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য মেঘনাথ চরিত্রের প্রশস্তি পাওয়া যায়?

ছোটবেলায় মেঘনাথ লেখাপড়া নিয়ে বাবার কাছে অনুপ্রেরণা না পেলেও দাদা জয়নালের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে তিনি কলকাতায় পড়তে এলেন। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ওই কলেজের প্রকৃত সর্বোত্তম স্বর্ণযুগ সেই সময়ই। মেঘনাথ সাহা , সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নিখিল রঞ্জন সেন এরা সকলে একসঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে পদার্থবিদ্যা পড়েছেন ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কাছে রসায়নবিদ্যা পড়েছেন । যে মেস বাড়িতে থাকতেন সেখানে তখন প্রায় নিয়মিত আসতেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় । তিনি বাঘাযতীন নামে আমাদের কাছে বেশি পরিচিতি। দুজনের অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ হলো। পড়াশোনায় যে মেঘনাথ যথেষ্ট ভাল ছিলেন সেকথা সকলেই জানতেন। বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম হতেন মেঘনাথ দ্বিতীয় । এমন বিপ্লবী সান্নিধ্যে তাকে ভুগতে হলো । ইচ্ছে ছিল ইন্ডিয়ান ফিনান্স সার্ভিসের চাকুরিতে যোগ দেবেন । ভাল মানের চাকরি। সেসময় এই চাকরি পেতে গেলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে হয় । বিপ্লবী যোগসাজশে খবর ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। পরীক্ষার অনুমতি মিলল না। আজ মনে হয় ভালই হয়েছে, নইলে হয়তো বা এক হোমরা-চোমরা সরকারি চাকুরে পেতাম। উজ্জ্বল এক বিজ্ঞানী কে পেতাম না । পেতাম না সাংসদকে। সংসদের সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন উচ্চশিক্ষা থেকে শিল্পায়ন, বন্যানিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্বাস্তু সংকট তীব্র তর্ক-বিতর্কে আলোড়িত হয়েছে ভারতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে তার একাধিক স্মরণীয় বিতর্ক সাংসদকে সমৃদ্ধ করেছে । জাতপাত ও দেশ ভারত জাতের নামে বজ্জাতি চলে। চলে ধর্মের নামে ও। মেঘনাদ জীবনের কিছু দুঃখবহ স্মৃতি মুছে ফেলবেন কি করে?

ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোর দিন সরস্বতী অঞ্জলি দেবেন বলে খুব ভোরবেলা থেকে প্রথমে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুরোহিত তাকে পেছনের সারিতে সরিয়ে দিয়ে উচ্চবর্ণের ছেলেদের আগে অঞ্জলি দিতে বললেন । চোখের জল মুছতে মুছতে সেই যে বেরিয়ে এসেছিলেন মেঘনাদ আর কখনো সরস্বতীর শরণাপন্ন হন নি।

মেধাবী ছেলেরা প্রেসিডেন্সির ছাত্র। দূরে বাড়ি যাদের ইডেন হিন্দু হোস্টেলে থাকে। কলেজটির নাম এক সময় বদলেছে। এখনতো কলেজ নেই বিশ্ববিদ্যালয় । কিন্তু হোস্টেলটির বিচিত্র নামেই মাখামাখি হয়ে রয়েছে। হোস্টেলের নামে একটি উইকিপিডিয়া আছে। বিখ্যাত আবাসিকে তালিকা আছে ৬ জনের নামে। অর্থনীতিবীদ সুখময় চক্রবর্তী, প্রদীপ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, রাজেন্দ্র প্রসাদ ,অমর্ত্য সেন, সুব্রত মুখার্জি এই তালিকা করার অভিযোগ করবো না। মেঘনাথ সাহা ছিলেন ,জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন, নীলরতন ধর ছিলেন ।একজন বিজ্ঞানীর নাম কি জায়গা পাওয়া উচিৎ ছিল না?

সত্যি বলতে কি হোস্টেল যখন কম বয়সী বন্ধুরা থাকে অনেক শুচিবায়ুগ্রস্ত মাথা তুলতে পারেনা । হিন্দু হোস্টেলে মেঘনাথ আরো অনেকের সঙ্গে খেতে বসেছেন কিছু আবাসিক তার সঙ্গে খাবারের ঘরে এক সারিতে বসে খেতে রাজি নন । সুখের কথা বিনা প্রতিবাদে সেই লজ্জাকর দৃশ্য সংগঠিত হতে পারেনি। সহপাঠী ও আবাসিক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এমন আচরণে তীব্র আপত্তি করেন। এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ম করে তাড়ানো যায়না মানুষ ধ্যান-ধারণার বদল প্রয়োজন। বন্ধু কজন বুঝলেন, এমন জায়গায় থাকা চলবে না। তাই বেরিয়ে গিয়ে ভিন্ন ঠিকানায় থেকে ছিলেন । এই জন্যই কি ঊইকিপিডিয়া তালিকায় তাদের জায়গা হয় না ? প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতারিত হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু । তার নামের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম কেউই দ্বিধাবোধ করেন না । হিন্দু হোস্টেল থেকে স্বেচ্ছায় চলে গেলেও মেঘনাদ বিতাড়িত হয়েছিলেন বলা চলে। এই বিষয়ে আজও কি কোন অনুশোচনা বা ধিক্কার প্রকাশের দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে ? সুভাষচন্দ্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। মেঘনাদ ও বন্ধু কজন সরে এসেছিলেন তাই কি ভাবনায় এমন বৈপরীত্য?

স্বাদেশিকতা রক্ষার লড়াই করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাত দশক পরেও যে সামাজিক অসুখে সারাদেশ জরাজীর্ণ , তার অবসানে ওই বন্ধু কজন কথা কি আমরা নতুন করে ভাবতে রাজি আছি ?
ছাত্রজীবনে যে বাঁধা পেয়েছেন কর্মজীবনেও তা থেকে মুক্তি পাননি মেঘনাদ। তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । মনে পড়ছে আমাদের নীলরতন ধর তার সমগ্র কর্মজীবন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কাটিয়েছেন । তিনি ছিলেন এক বছরের বড় মেঘনাদের চেয়ে। মেঘনাদ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ১২২৩ সালে গিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। নীলরতন ছাত্র জীবনের বন্ধু ছিলেন তেমনি আর একজনের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ।তার নাম অমিয়চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবনে বারবার উচ্চারিত হবার মতো একটি নাম বোধ হয় । তিনি বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছেন।

১৮৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি তার জন্ম। অমিয়চরণ কথা বলতে গেলে তার বাবা জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অবশ্যই খানিকটা বলতে হয় । জ্ঞানচন্দ্র মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন। ছাত্রজীবনে নরেন্দ্রনাথ পরে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বন্ধু ছিলেন। দক্ষিণ 24 পরগনা মহেশতলা জমিদার ছিলেন। ছাত্রজীবনে কেশব চন্দ্র সেন মহাশয় কয়েকটি বক্তিতা শুনে ব্রাহ্মধর্মের আকৃষ্ট হন ও একসময় ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। বাবা জ্ঞান চন্দ্রকে ব্রাহ্ম শিবির থেকে সরিয়ে আনার মতো সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। তিনি ছেলেকে সমস্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন । জ্ঞানচন্দ্র পড়াশোনা করেছিলেন বিহারে গিয়ে। তিনি জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট সভ্য নিবারণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। জ্ঞানচন্দ্র জীবন ইতিহাস ও জামাতা জ্ঞানচন্দ্র মতই ছিল।
বাবা তার হুগলিতে থাকতেন । তিনি ব্রাহ্ম সভার অপরাধী নিবারণচন্দ্র কে ত্যাজ্যপুত্র করেন। নিবারণ চন্দ্র তারপর ভাগলপুরে সরে এসে ব্রাহ্মসমাজের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বরিশালে লাখুটিয়া জমিদার বংশের কন্যা দিনতারিণী সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেই বিয়েতে কেশবচন্দ্র সস্ত্রীক গিয়েছিলেন। নিবারণচন্দ্র এক পুত্র ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তার নাম প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কাস প্রতিষ্ঠায় অবদান সকলেই মনে রাখেন । নিবারণচন্দ্র আর এক পুত্রের নাম সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। আই সি এস অফিসার তার পুত্র সুব্রত মুখার্জি ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম এয়ার মার্শাল নিযুক্ত হন। এমন করে বলতে গেলে খ্যাতিমান লব্ধপ্রতিষ্ঠ চরিত্রে প্রচুর দেখা যাবে। আমরা তাই আবার জ্ঞানচন্দ্রের পুত্র অমিওচরণের কথায় ফিরে যাই।

ভাগলপুরের মামাবাড়িতে জন্ম হয় অমিওচরণের ভাগলপুরের জেলা স্কুলে পড়েছেন মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সব পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছেন। তাঁর বিষয় ছিল গণিতবিদ্যা। বিহার সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করেন। কেমব্রিজের জাংলার হয়েছিলেন। তিনি এমন ভালো ফল করে দেশে ফিরে চাকুরী পেতে সময় লেগেছে । একসময় এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগে যোগ দেন। মেঘনাথ ও নীলরতন দুজনে সখ্য গড়ে ওঠে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে একাধিক বড় মাপের কাজ করেছেন অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সরকার তাঁকে আমেরিকা ও ইউরোপের মানমন্দির দেখে এসে ভারতের মানমন্দির উন্নয়নের উপদেষ্টা হিসাবে মনোনীত করেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করবেন এমনটাই ঠিক হয়েছিল। তার কিছুদিন আগে অধ্যাপক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটে। অবসর গ্রহণ করে তিনি পশ্চিমবাংলায় চলে এসেছিলেন। হাবরা শ্রীচৈতন্য কলেজ তৈরিতে তার অবদান রয়েছে। এ কথা বলতে ভালো লাগছে যে এলাহাবাদে তিনি যে বাড়িতে থাকতেন তার সামনের পথ তার নামে হয়েছে।
১৯৫৬ মেঘনাথ যখন মারা যান ‘সাইন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকায় তাকে নিয়ে লিখেছিলেন অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখার শিরোনাম ছিল ‘এলাহাবাদে মেঘনাদ সাহা’। ইংরেজি লেখা আমাদের এই নিবন্ধে সেই রচনা থেকে কয়েকটি কথা তুলে আনলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
অমিওচরণ লিখেছিলেন ‘যখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিভাগে এমএসসি ক্লাসের ছাত্র তখন বিএসসি ক্লাসের ছাত্র মেঘনাদের নাম আমার কানে আসে। মেধাবী ছাত্র হিসাবে মেঘনাদের সুনাম ছিল। আরো সুনাম ছিল নিজের চেষ্টায় সে ফরাসি আর জার্মানি ভাষা শিখে ছিল ‘।

১৯২০ সালে অমিও চরণ দেশে ফিরে মুয়্যার সেন্ট্রাল কলেজে যোগ দেন। সেখানে তখন নীলরতন অধ্যাপনা করেছিলেন। ১৯২১ সালে কলেজ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় মিশে যায়। সে সময় পদার্থবিদ্যার একটি অধ্যাপক পদ তৈরি হলো। অমিওচরণ ও নীলরতন দুজনেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে একজন মেধাবী কাউকে খুঁজছেন ওরা। এরপর অমিও চরণ তার লেখায় যা বলেছেন তা এরকম :,
সাহার কথা আমরা দুজনেই ভাবছিলাম। বছর কয়েক আগে সে বিখ্যাত তাপ আয়নন সূত্র আবিষ্কার করেছে। আইনস্টাইন এডিংটন ও রাসেল এরা সকলেই তাঁর খুব প্রশংসা করেছেন। দলীয় রাজনীতি আর কিছু মানুষের ঈর্ষাকাতর তার মনোনয়নে বাদ সাধছিল। শত্রুপক্ষ বেশ জোরদার। কেউ কেউ বলছিলেন, সাহা এখনো এফ আর এস হননি। তার ডিগ্রী গণিতের, পদার্থবিদ্যার নয়। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় একজন সদস্য পকেট থেকে বের করে বললেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মতে মেঘনাদের কাজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওই ভদ্রলোক কিন্তু বিরোধী পক্ষের বেশ প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। যাইহোক আইনস্টাইন এর গুরুত্ব শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে যোগ দিতে পারলেন । ক্ষমতার রাজনীতি ও যে লেখাপড়া জগৎটাকে কেমন করে রেখেছিল আজও মনে পড়ে।
তিনি বেঁচে থাকলে তার কাছে আমরা জানতে চাইতাম। তেমন আবহাওয়া কি আমাদের চারপাশ থেকে আজ লুপ্ত হয়েছে? কি উত্তর দিতেন জানিনা। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই স্মৃতি নিবন্ধ থেকে আরো দু’একটি কথা আমরা যোগ করতে চাই। বহু রকমের বিষয়ে মেঘনাদের গভীর পড়াশোনা ছিল। ইতিহাসবিদ্যয় তিনি পন্ডিত ছিলেন। বিশেষত প্রাচীন ইতিহাসবিদ্যা। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন বহু বিষয়ে পণ্ডিত অধ্যাপক দেখেছি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে চূর্ণ হয়েছে। অমিয়চরণের কথায় মেঘনাথ ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান দর্শন ও পান্ডুলিপি শাস্ত্রে সত্যি বিশেষজ্ঞ। গণিত তো তিনি জানতেন রসায়ন ও ভূতত্ত্ববিদ্যা তার জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন অমিওচরন, যে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা । ডক্টর গঙ্গানাথ ঝা তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য। ১৮৭২ সালে তার জন্ম মেঘনাথ তারচেয়ে 21 বছরের ছোট ছিলেন সংস্কৃত ভারতীয় দর্শন বৌদ্ধ দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত হিসেবে গঙ্গানাথ ঝা কে সকলেই মানেন। ১৯২৩ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত গঙ্গা নাথ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বহু সাম্মানিক উপাধি পেয়েছেন । ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছেন । বই লিখেছেন। তার সকল সন্তানেরা অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। বিশেষত অমরনাথের কথা বলতেই হয়।
৫৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মাত্র ৩২ বছর বয়সে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগ দেন । বাবার পরে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ চলে গেলে সেখানে অমরনাথ উপাচার্য হন। উত্তর প্রদেশ লোকসভা ও বিহার লোকসভা আয়োগ এর সভাপতি হয়েছিলেন। অমরনাথের দ্বিতীয় পুত্র আদিত্যনাথ আই সি এস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন।

গঙ্গানাথ তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মেঘনাদ সেসময় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন । কাউন্সিলের সভায় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের পাঠক্রম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল । মেঘনাদ বললেন এই পাঠক্রম আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। খানিকটা বিরক্ত হয়েই উপাচার্য বলেছিলেন একজন বিজ্ঞানী এই বিষয়ে কি বলার থাকতে পারে । মেঘনাথ কোন বিতর্কে আর এলেন না । গঙ্গানাথ পরে প্রাচীন ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এই বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সকলেই মেঘনাদের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিষয়ের প্রগাঢ় পান্ডিত্যের কথা স্বীকার করেছেন। বড় মনের মানুষ ছিলেন গঙ্গা নাথ নিজের ভুল ত্রুটি স্বীকার করতে সংকুচিত বোধ করতেন না । পরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় সকলের সামনে উপাচার্য গঙ্গানাথ মেঘনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন অমিয়চরণ। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। ১৯২৬ সালে মেঘনাথ যখন রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন বিশ্ববিদ্যালয় আনন্দে বয়ে যায়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কেউ একজন এফ আর এস হয়েছেন। এক বিশাল সংবর্ধনা সভার আয়োজন হয়েছিল। উপাচার্য গঙ্গনাথ ঝা শুধুমাত্র মেঘনাদের প্রশংসা করেননি। শেষে বলেছিলেন , যারা এতকাল মেঘনাদের কাজকে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছেন নিশ্চয়ই তাদের ভুল কাটবে। সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে ভালোবাসতেন। তোষামোদ তার স্বভাবে ছিলনা। অমিওচরণে কথায় , সারা দুনিয়া তার উল্টো কথা বললেও তিনি যা সঠিক মনে করতেন তাই বলতেন।
প্রতি সন্ধ্যায় এক লম্বা ভ্রমণের নিয়মিত সদস্য ছিলেন মেঘনাথ ও অমিওচরণ। মাস্টারমশাই প্রফুল্ল চন্দ্রের সঙ্গে নিয়মিত গড়ের মাঠে বেড়াতে যাবার অভ্যাস ছিল। তার এই অভ্যাস ত্যাগ করেননি। প্রতিদিন এলাহাবাদের মাইল পথ হাঁটতেন ।তখন নানা বিষয়ে কথা হতো বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি , দর্শন কিছুই থাকত না বাদ।
বিজ্ঞানী হিসেবে মেঘনাথ যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করলেও গবেষণার প্রয়োজনীয় টাকা করি সংগ্রহ করতে পারছিলেন না। ১৯২২ সালে ২৬ এপ্রিল তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেলের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন চিঠির খানিকটা এরকম,
যে ইনস্টিটিউটে আমি কাজ করছি সেখানে জ্যোতি পদার্থবিদ্যার বইপত্র খুব কম আমাকে ভীষণ অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। আমি ভেবেছি কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু এখনকার বইপত্র মহাজাগতিক মানচিত্র কিনতে বলবো। ১৯২৩ সালের পহেলা আগস্ট মেঘনাদ রাসেলের কাছে একটি বই চেয়ে পাঠান। ১৪ নভেম্বর লিখলেন, তুমি অবশ্যই এই প্রত্যাশা করো। আমি ডক্টর অ্যাডামস কে পাঠাতে বলেছি। পরাধীন ভারত। সরকারের কাছে টাকা চাইলে খুব সামান্য পরিমাণ টাকা মঞ্জুর হচ্ছে। নয়তো সরকার কিছুই দিচ্ছেন না। ১৯২১ সালে যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় খয়রা অধ্যাপক, নিজের গবেষণার জন্য মাত্র ১২ পাউন্ড দামের একটি অয়েল পাম্প চেয়েছিলেন। বিভাগের তহবিলে তখন আর কোনো টাকা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এলাহাবাদে যোগ দেওয়ার পরেও সেই চিত্রের বিশেষ বদল ঘটেনি।

অনেক ঝড় জলের পর সাহা রয়েল সোসাইটির ফেলো হতে পেরেছিলেন। যোগ্য থাকলেই কি স্বীকৃতি পাওয়া যায়? গোপনে তার বিষয়ে তদন্ত হলো। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো থেকে লিখে পাঠানো হয়, ‘….is a rabid revolutionary and has been mixed up with various sorts of anti British propaganda.’
বাংলায় অনুবাদের কোন প্রয়োজন দেখছিনা । কৃতজ্ঞতা জানাবো দুই বিজ্ঞানী কে রাফেল গিল বাট ও ওয়ার্কার। এরা দুজন মেঘনাদ কে ফেলো করার প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন। এদের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট পাঠিয়ে নতুন করে মতামত চাওয়া হয় । বিজ্ঞান প্রতিভার স্বীকৃতিতে ওরা গোয়েন্দাগিরি চাতুর্যে কাছে পরাস্ত হতে দেননি ।
‘নেহেরু- ভাবা -সাহাকে ‘ নিয়ে এক বিশাল উপন্যাস রচনা করা যায়। নেহেরুর সিংহভাগ পৃষ্ঠপোষকতা বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা ওপর বর্ষিত হচ্ছিল। যে মানুষটি আমাদের দেশে প্রথম নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার স্নাতক পাঠক্রম পরিবর্তন করেছিলেন ও নিউক্লিয় পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা শুরু করেছিলেন তাকে অনুদান দেওয়ার বেলায় নেহেরু উদার হতে পারেননি । নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী। নিউক্লিয় শক্তি গবেষণা পরিকাঠামো নির্মাণ তার অবদান অনস্বীকার্য । তিনি কি সামর্থের প্রতি ঈষকাতর ছিলেন? দুটি ঘটনার কথা বলব।

এক, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তার কাছে একটি চিঠি লিখে ভাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মেঘনাদ। একটি চিঠি লেখা ছিল এক ছাত্রের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ এর জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর পাঠানো হয়েছিল তা ভাবার ইন্ধনে প্রকাশের অযোগ্য বলে ফেরত আসে। অথচ একই গবেষণাপত্র আমেরিকার বিখ্যাত যোর্নাল ফিজিক্যাল রিভিউতে ছাপা হয়ে যায়। এই চিঠি মেঘনাথ সাহা লিখেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১০ই এপ্রিল। দেশ তখন স্বাধীন । শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নেহেরুর প্রথম মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দুই, ১৯৩৫ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র কে সভাপতি করে মেঘনাথ সাহা করে তুলেছিলেন ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন। এই অ্যাসোসিয়েশন থেকে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার নামে একটি পত্রিকা আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ইউনেস্কোর কাছে মেঘনাদ এই পত্রিকার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিলেন । সেসময় বিষয়টি দেখার প্রধান দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞান ঐতিহাসিক জোসেফ নিডহ্যাম। ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ লেখক সমরেন্দ্রনাথ সেন তখন কর্মসূত্রে ইউনেস্কোতে রয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর একটি চিঠি লিখেছিলেন মেঘনাদ কে । বাংলায় আমরা তার কিছু জায়গা অনুবাদ করব।
‘সাইন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকার ইউনেস্কো অনুদান বিষয়ে আমাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি অধ্যাপক ভাবা তার পুরোটাই ভেস্তে দিয়েছেন । তিনি কার্যকারী শাখার সভায় বলেন , ভারতীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান এমন কোন কাজ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকল্পটি নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল ডক্টর নিডহ্যাম উঠে দাঁড়িয়ে প্রকল্পের পক্ষেই কথা বলেছিলেন । অধ্যাপক ভাবা সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে বললেন ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ ভারতীয় প্রকাশনার এমন আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন নেই । ভারতীয় প্রতিনিধি দলে একজন সদস্যকে এমন অপ্রত্যাশিত বিরোধিতা করতে দেখে নিডহ্যাম আর কথা না বাড়িয়ে অন্য বিষয়ে চলে গেলেন।’
পদে পদে জাতের নামে বজ্জাতি দেখেছেন মেঘনাদ। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ৬০ বছর পার হয়েছে । ভারতের গভর্নর জেনারেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন তৈরীর কথা ঘোষণা করেছেন। বিগত কয়েক বছর ধরে অবিভক্ত বাংলার প্রতিবাদী ইংরেজ সরকার মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে তরুণরা। ৯২ সার্কুলার রোডের ঠিকানা বিজ্ঞান কলেজ তৈরি হয়েছে তখন পাঁচ বছর হয়েছে। নতুন কলেজের অধ্যাপক প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকারের প্রতিনিধিরা এসে বারবার বাধা দিচ্ছেন। নতুন কোন পদে তারা অনুমোদন করছেন না । ১৯১৭ সালের কমিশনকে আমরা স্যাডলার কমিশন হিসাবে সকলে জানি। এই কমিশনের একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে ৬৭১ জনের হাতে দিয়েছিলেন। প্রশ্নপত্র প্রাপকদের তালিকা ইম্পেরিয়াল বিধান পরিষদের বাংলা সদস্যরা ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ফেলো , কলা ও বিজ্ঞান শাখা স্নাতকোত্তর অনুষদের সভ্যবৃন্দ, ডিপিআই কলেজের অধ্যক্ষ বৃন্দ, স্কুলের পরিদর্শক ও প্রধান শিক্ষক ভারতের সকল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য গন কয়েকজন জমিদার ও শিল্পপতি এই প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন। নানা বিষয়ে প্রশ্ন ছিল ।পঠন-পাঠন , প্রশাসন, পরীক্ষা ছাত্রাবাস, নারী শিক্ষা , সংখ্যালঘুদের শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অভিমত জানাতে হবে । একজন প্রশ্ন প্রাপক ছিলেন মেঘনাথ সাহা। জাতীয ও বর্ণভেদ প্রথা স্বদেশে কেমন সর্বনাশ করে চলেছে, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জেনেছেন। বেশির ভাগ উত্তরদাতা ছাত্রাবাসে কথা বলতে গিয়ে মুসলিম ও অনগ্রসর সম্প্রদায় ছাত্রদের কথা বলেছেন। মেঘনাদ বললেন একটু ভিন্ন ভঙ্গিতে।

যাদের সকলে ‘depressed class’ চিহ্নিত করেন। মেঘনাদ তাদের বলতেন ‘Democratic class’। তিনি সোজাসুজি লিখেছিলেন এ বহুদিনের অভিযোগ যে বিভিন্ন কলেজে ছাত্রাবাসগুলোতে বাস্তবিকপক্ষে কয়েকটি অভিজাত শ্রেণীর রাজত্ব চলছে ব্রাহ্মণ ,কায়স্থ, বৈদ্য এদের। ‘Democratic class’ এর ছাত্রদের নেওয়া হয় না । যদিওবা নেওয়া হয় অধিকার হিসাবে দেখা হয় না। করুণা প্রদর্শন করা হয়। যদি একই ঘরে উভয় ধরনের ছাত্রকে থাকতে দেওয়া হয়, একই খাবার ঘরে একসঙ্গে খেতে হয় হতভাগা ছেলেটিকে ওই ঘর থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তাকে আলাদা বসে খেতে বলা হয় এমন বহু ঘটনার কথা আমি নিজে জানি।’
যদি অনুসন্ধানী পাঠক বন্ধুদের কেউ মূল্যে খাঁটি পড়তে চান তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টের আট নম্বর ভলু্্যমের পৃষ্ঠা দেখে নেবেন মনে । রাখতে হবে এই বিবরণ ১০০ বছর আগেকার । বিপদের প্রাবল্য নিশ্চয়ই খানিকটা এখন কমেছে । শুন্য হয়ে গিয়েছে এমন দাবি করবো না । প্রতীকী ট্রাস্টের সমীক্ষা থেকে মফস্বল বাংলার স্কুলে এমন একটা ছবি উঠে এসেছিল বছর কয়েক আগে।

মেঘনাথ বলতেন সমানাধিকারের কথা। বিশেষ সুযোগ দানের ভাবনা তিনি কোনোকালেই পছন্দ করেননি। যে নথিকথা আগে বলা হয়েছে সেখানেই মেঘনাদ পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সরকারি টাকায় যে ছাত্রাবাস গুলি তৈরি হয়েছে অন্তত সেই ছাত্রাবাসগুলোতে অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্রদের মত ওদের সমান অধিকার থাকা উচিত। তারা চায় স্বাভাবিকভাবে ছাত্রাবাসগুলোতে জায়গা হোক । আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানের যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে । আলাদা ছাত্রাবাস তৈরীর পক্ষে আমার মত নেই। তাহলে প্রতি কলেজে অন্তত ২৫ খানা ছাত্রাবাস চাই। আমাদের তো জাতপাত কম নেই। জাতপাতের বিবেচনায় সমাজে শ্রম নির্বাচন হলে সেই সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য । সারা জীবন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র। সোচ্চার আচার্যের প্রিয়তম মানস সন্তান মেঘনাদ। মনে পড়ে আমাদের ১৯৩৮ সালের ১৩ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার বক্তিতা কথা। রবীন্দ্রনাথ তখনো বেঁচে। আমন্ত্রিত মেঘনাথ তার বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘হিন্দু সৃষ্টিকর্তার একজন দার্শনিক।’ তিনি ধ্যানে বসিয়া প্রত্যক্ষ জগত স্থাবর জঙ্গম জীব এবং ধর্মশাস্ত্রে সমস্ত সৃষ্টি করিয়াছেন। সেই জন্য যারা মাথায় অলস দার্শনিকদের আলোচনায় সময় নষ্ট করে এবং নানারূপ রহস্যের সৃষ্টি করে, হিন্দু সমাজে তাহাদিগকে খুব বড় স্থান দেওয়া হইয়াছে। শিল্পী কারিগর ও স্থপতি স্থান এই সমাজের নিম্ন স্তরে। এবং হিন্দু সমাজে হস্ত ও মস্তিষ্কে পরস্পরের কোন যোগ নয়।
একবিংশ শতাব্দীতে যে বাবা-মায়েরা মেঘনাদ নাম রাখেন নিশ্চয়ই রাবণ পুত্র মেঘনাদের এর কথা মনে করে সেই নাম রাখেন না বিজ্ঞানী মেঘনাদ এর কথাই তাদের মনে পড়ে।

Leave a comment