ওয়াকফ কী?ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন কি বলা হয়েছে ?(Waqf Amendment Act, 2025)

​ভারতে সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ (Waqf (Amendment) Act, 2025) ১৯৯৫ সালের মূল ওয়াকফ আইনকে সংশোধন করে। এই আইনটি ৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হয় এবং ৫ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে এটি কার্যকর হয়েছে।

ওয়াকফ কী?

ওয়াকফ বলতে বোঝায় এমন একটি স্থায়ী দান, যেখানে কোনো ব্যক্তি নিজের মালিকানাধীন সম্পদ যেমন জমি, বাড়ি, দোকান ইত্যাদি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে দেন। এরপর সেই সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয় গরীব-দুঃখী, মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে ব্যয় হয়।

ওয়াকফের বৈশিষ্ট্য:

  • ওয়াকফের সম্পত্তি বিক্রয়যোগ্য নয়।
  • একবার ওয়াকফ করে দিলে সেটি আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
  • ওয়াকফকৃত সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয় বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার হয়।

🔑 প্রধান পরিবর্তনসমূহ

  1. ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তি: নতুন আইনে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে কমপক্ষে দুটি অ-মুসলিম সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, রাজ্য স্তরে একজন অ-মুসলিম প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ​PRS Legislative Research
  2. ওয়াকফ সম্পত্তির সনাক্তকরণে জেলা কালেক্টরের ক্ষমতা: আগে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল ওয়াকফ সম্পত্তির সনাক্তকরণ করলেও, নতুন আইনে জেলা কালেক্টরকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো সম্পত্তির ওয়াকফ হওয়া নিয়ে বিতর্ক থাকে, তবে জেলা কালেক্টর তা সরকারের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন।
  3. ওয়াকফ বোর্ডে নারী ও সম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অন্তত দুটি মুসলিম নারী সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, শিয়া, সুন্নি, বোহরা, আগাখানি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
  4. ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধন প্রক্রিয়া: ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধন ও অডিটের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
  5. ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল ও বোর্ডের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে, এবং অনেক সিদ্ধান্তের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এটি বোর্ডের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ​

⚖️ সমালোচনা ও উদ্বেগ

  • ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন: বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন, যেমন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, এই আইনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, অ-মুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি ও সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন। ​
  • সম্পত্তি অধিকার নিয়ে উদ্বেগ: আইনে “ওয়াকফ বাই ইউজার” (Waqf by User) ধারাটি বাতিল করা হয়েছে, যা ঐতিহাসিকভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহৃত জমি সংরক্ষণে সহায়ক ছিল। এটি অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত সম্পত্তি হারানোর আশঙ্কা তৈরি করেছে। ​
  • আইনি সীমাবদ্ধতা: আইনের ১০৭, ১০৮ ও ১০৮এ ধারাগুলি বাতিল করা হয়েছে, যা ওয়াকফ সম্পত্তির ক্ষেত্রে লিমিটেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৩ প্রযোজ্য করবে। এটি দীর্ঘ সময় ধরে অবৈধভাবে দখল করা সম্পত্তি অধিকারীকে বৈধতা দিতে পারে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগজনক।

🏛️ আইনের বর্তমান অবস্থা

এই আইনটি বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। কংগ্রেস সাংসদ মোহাম্মদ জাওয়েদ ও অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (AIMIM) প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি পৃথকভাবে সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন।

🕌 ওয়াকফ আইন ভারতে: বিস্তারিত বিশ্লেষণ

🧾 মূল ওয়াকফ আইন – ১৯৯৫

ভারতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়াকফ আইন আসে ১৯৯৫ সালে – The Waqf Act, 1995। এই আইনের মাধ্যমে:

  • প্রতিটি রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
  • ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষায় আইনি কাঠামো তৈরি হয়।
  • ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা হয়।

⚖️ ২০২৫ সালের সংশোধনী (The Waqf Amendment Act, 2025)

২০২৫ সালে মোদি সরকার এই আইনে বড় ধরনের সংশোধনী আনে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে আলোচনা করা হলো:

🧠 কেন এই সংশোধন আনা হলো?

সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী:

“ওয়াকফ” এর নামে বহু সরকারি ও ব্যক্তিগত জমি বেআইনিভাবে দাবি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আসে, যার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে।

ওয়াকফ বোর্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো দরকার।

ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণমূলক নীতি প্রয়োগ।

🔍 সংশোধিত আইনের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক:

1️⃣ ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্য:

এটি সবচেয়ে বিতর্কিত পরিবর্তনগুলোর একটি। প্রথমবারের মতো:

  • অ-মুসলিমদের বোর্ড সদস্য করা হয়েছে।
  • সমালোচকরা বলছেন, এটি ইসলাম ধর্মীয় ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।

2️⃣ জমির মালিকানা নিয়ে জেলা কালেক্টরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত:

আগে যদি ওয়াকফ নিয়ে কোনো বিরোধ হতো, তাহলে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে যেতে হতো। এখন:

  • জেলা কালেক্টর যদি বলেন কোনো জমি ওয়াকফ নয়, তাহলে সেটিই চূড়ান্ত ধরা হবে।
  • এতে মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক জমিগুলো রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

3️⃣ “ওয়াকফ বাই ইউজার” বাতিল:

  • “ওয়াকফ বাই ইউজার” মানে যে জমি বহু বছর মসজিদ/ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি ওয়াকফ হিসেবে বিবেচিত হবে।
  • এখন এটি বাতিল করা হয়েছে, ফলে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত বহু জমি আর ওয়াকফ হিসেবে বিবেচিত হবে না।

4️⃣ আইনি সুরক্ষা কমানো:

  • আগের আইন অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো সরকারি নিলামে তোলা যেত না।
  • সংশোধিত আইনে এই সুরক্ষা দুর্বল হয়েছে।
  • এখন অনেক ক্ষেত্রে সরকার সেই সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারবে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ:

মুসলিম সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ:

  • AIMIM প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, জামিয়ত উলামা-ই-হিন্দ সহ বহু সংগঠন এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
  • তাদের বক্তব্য: এটি মুসলিমদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করছে।

🧑‍⚖️ সুপ্রিম কোর্টে মামলা:

  • এই আইনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও AIMIM সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছে।
  • মামলার রায়ের দিকেই এখন নজর সকলের।

📊 কে কী বলছে?

পক্ষমতামত
কেন্দ্রীয় সরকারস্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
মুসলিম নেতৃবৃন্দএটি ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ
আইন বিশ্লেষকসংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে এই বিল

Leave a comment