অম্বানি দের বিয়ের অনুষ্ঠানে বড়ো বড়ো নামী দামী শিল্পীদের গান করতে দেখা গেছে । আমেরিকা পপ গায়িকা রিহানা থেকে শুরু করে অরিজিৎ সিং , শ্রেয়া ঘোষাল সবাই গান গেয়েছেন । সালমান খান থেকে শুরু করে শাহরুখ খান আমির খান সকলেই বর্তমান যুগে নাচ করেছেন বিয়ের সঙ্গীত অনুষ্ঠানে । কিন্তু জানেন কি লতা মঙ্গেশকর এই সব বিষয় থেকে শত হস্ত দূরে থাকতেন । তাকে কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গাইতে বলা হলে তিনি এই সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতেন । কিন্তু কেন জানেন কি ?
অনন্ত অম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্ট এর প্রাক বিবাহ অনুষ্ঠানে হাজির ছিল গোটা বিশ্বের গণ্য মান্য ব্যাক্তিত্বরা। মাইক্রোসফট এর নির্মাতা থেকে শুরু করে ফেসবুক নির্মাতা মার্ক জুকারবার্গ কে ছিল না তাতে । ১৭১ কোটি টাকার বিনিময়ে পপ গায়িকা রিহানা অম্বানি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সকলের মনোরঞ্জন করেছেন । কিন্তু লতা জি বেচে থাকাকালীন তাকে এমন সব জাকযমক পূর্ণ অনুষ্ঠানে গান করার জন্যে কোটি টাকা দিতে চাইলেও তাকে কোনদিন কেও রাজি করাতে পারে নি । এক রিয়ালিটি শো তে সেই কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর তার ছোট বোন আশা ভসলে ।
একবার এক নামী বড়লোক ব্য়াবসায়ী পরিবারে বিয়ে উপলক্ষে তাকে গান করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়ে ছিল । তিনি সব তাই নাকচ করে দিয়েছিলেন । তাকে ৫১ কোটি টাকা অফার করা হয়ে ছিল । এক রিয়ালিটি শো মঞ্চে দাড়িয়ে আশা জি বলেছিলেন “লতা দিদি কে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গান করার জন্য এক মিলিয়ন ডলাররের প্রস্তাব দেওয়া হয়ে ছিল । কিন্তু তিনি বলেছিলেন আমাকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হলেও আমি গাইব না ।”
এমনটাই ছিলেন লতা মঙ্গেশকর । গাইতে গাইতে অনেক তারকাই মঞ্চে নাচেন । লতা জি কে তেমন তাও করতে দেখা যায় নি কোনদিন । তিনি চিরকাল সাদামাটা শাড়ি পরে মঞ্চে উঠতেন গান করতে । মাথার মাঝে সিঁথি কেটে দুটি বিনুনি বেঁধে মঞ্চে উঠে একের পর এক গান গাইতেন লতাজি । তার সঙ্গে থাকত অর্কেস্ট্রা। মঞ্চে নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করতে হয়, তা শুরু থেকেই জানতেন ‘ভারতের নাইটিংগেল’। বোন আশা সম্পর্কে একবার দুঃখপ্রকাশ করে লতা বলেছিলেন, “আমি ওর মতো নাচতে নাচতে গাইতে পারি না মঞ্চে। কী করব বলুন আমার ওটা আসে না।” সেই লতাকে বিয়ের প্রাইভেট পার্টিতে পারফর্ম করতে বলাই অলীক কল্পনা। তিনি চিরকালই এই সব অনুষ্ঠানে গান করবার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন বরাবর ।
দশকের পর দশক ধরে গোটা বিশ্ব কে তার সুরের জাদু তে মোহিত করে রেখেছেন মানুষ কে । ১৯৪২ সালে প্রথম একটি মারাঠি ছবিতে প্রথম গান রেকর্ড করেন । পরের বছর মারাঠি ছবি ‘গাজাভাউ’ এর জন্যে ‘মাতা এক সুপুত কি দুনিয়া বদল ডে তু ‘ গানটি রেকর্ড করেন । এটি ছিল তার প্রথম হিন্দি গান । তারপর ধীরে ধীরে ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ধ্রুপদী গানের তালিম নেন । প্রতি পদে পদে বলীউড এ টিকে থাকার লড়াই করেন। এবং ধীরে ধীরে পা তলার মাটি শক্ত করেন তিনি ।
প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় ‘শহীদ’ ছবিতে লতাকে দিয়ে গান গাওয়াতে রাজি হতে চান নি । তখন সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দারকে তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েটার গলাটা বড্ড সুরু’।কিন্তু মিউজিক ডিরেক্টর গুলাম হায়দার পালটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন, আগামিদিনে এই মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়াতে পায়ে ধরবে গোটা বলিউড। এরপর তাঁর হাত ধরেই বলিউডে প্রথম বড় ব্রেক পান লতা জি । মজবুর (১৯৪৮) ছবির ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহিন কা না ছোড়া’ গানটি রেকর্ড করেন তিনি । শিল্পীর কথায়, ‘গুলাম হায়দার আমার গডফাদার’। শুরুর দিকে লতার গায়েকিতে নূর জাহানের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে, তবে দ্রুত তা কাটিয়ে উঠে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা জি । লতা মঙ্গেশকর তাঁর সাত দশক দীর্ঘ কেরিয়ারে এক হাজারেরও বেশি হিন্দি ছবির গান রেকর্ড করেছেন এবং গান গেয়েছেন ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায়। লতা মঙ্গেশকরের সব বিখ্যাত গানের তালিকা অগুনতি, ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’, ‘লাগ জা গলে, ‘চলতে চলতে’, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’- এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
ভারতীয় সংগীতের দুনিয়ায় লতা মঙ্গেশকরের অবদান এক কথায় ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে, লতাজি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান এবং ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসমারিক নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার (অফিসার অফ দি লেজিয়ান অফ অনার) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি সুরের সরস্বতী, আর ভগবান তো অবিনশ্বর, তাই সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে এভাবেই চির ভাস্বর হয়ে থেকে গেলেন তিনি।