” সপ্তগ্রামের ইতিহাস ,বাঁশবেড়িয়ার রাজবাড়ী , হংসেশ্বরী ও অনন্ত বাসুদেব মন্দির “!
কলকাতারের উত্থানের আগে বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল “সপ্তগ্রাম ” ৷
যার কাহিনী মনসামঙ্গল , চন্ডীমঙ্গল ,শেরশাহ , মুঘল , বাংলার নবাব থেকে পর্তুগীজদের বিবরণ
থেকে পাওয়া যায় ৷ পর্তুগীজরা একে বলতো Poro Pequeno. কান্যকুব্জের রাজা প্রিয়বন্তের সাত ছেলে অগ্নিত্র , মেধাতিথি , বপ্যুমান , জ্যোর্তিষ্মান ,দ্যুতিষ্মান , সবন ও ভব্য পুণ্যলাভের আশায় গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম স্থলে সাতটি আশ্রম তৈরী করেন ৷ সাতটি পাশাপাশি গ্রামে আশ্রমগুলি ছিল ৷ বংশবাটী , কৃষ্ণপুর , শিবপুর , নিত্যানন্দপুর , বাসুদেবপুর , বলদঘাটি ও সাম্বাচোরা ৷ এই সাতটি মিলে হয় “সপ্তগ্রাম ” ৷যা পরে বঙ্গের প্রধান তিনটি জনপদ লক্ষ্মণাবতী , সূবর্ণগ্রামের মত সপ্তগ্রাম ৷ এখানে প্রথম মন্দির হলো অনন্ত বাসুদেব মন্দির ৷ একরত্ন শৈলীর ৷চূড়া অষ্টভূজাকার ৷ অসাধারন টেরাকোটার কাজে রয়েছে রামায়ণ , মহাভারত থেকে কৃষ্ণলীলার
নানা কাহিনী খোদিত ৷ এই মন্দির দেবমূর্তি বহুবছর আগে খোয়া গেছে ৷
অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরের পাশেই বাংলার বিখ্যাত ত্রয়োদশরত্নের পাঁচ তলার ” হংসেশ্বরী মন্দির ” ৷ বাঁশবেড়িয়ার বা বংশবাটীর রাজা নৃসিংহদেব তাঁর মা হংসেশ্বরী দেবী মারা যাওয়ার পর একরাতে স্বপ্নে দেখেন নিজের মৃত মাকে জগজ্জননী রূপে ৷ তাই
হংসেশ্বরী দেখতে ঘোমটা টানা ঘরের মা ৷ ১৭৯৯ সালে শুরু করেন এই মন্দিরের ৷ ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা গেলে ৷ পালিত পুত্র কৈলাসদেবের মামলা সহ অনেক প্রতিকূলতা সত্বেও স্বামীর ইচ্ছাপূরণের লক্ষ্যে ১৮১৪ সালে শেষ করেন তাঁর বিধবা স্ত্রী ছোটরাণী শঙ্করী৷ তখনকার দিনে ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয় ৷ বংশবাটী তৎকালীন বিখ্যাত বন্দর
সপ্তগ্রামের অন্তর্গত ৷ পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর পাটুলীতে ৷ তাঁরা ছিলেন মুঘল সম্রাটদের বিশ্বাসভাজন কর্মচারী ৷ আকবরের কাছে এনারা
“রায়” এবং জাহাঙ্গীরের কাছে ” মজুমদার” উপাধি পান ৷ পাটুলীর “দত্তরায় “রা ছাড়া অবিভক্ত বাংলায় চারটি “মজুমদার” উপাধিপ্রাপ্ত ( যেমন নদীয়ার রাজারা ) পরিবার ছিল ৷ পাটুলীর দত্তরায়রা ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহ্ জাহানের
কাছে সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ সহ ২১টি পরগণার জায়গীর লাভ করলে রাঘব দত্তরায়ের ছেলে রামেশ্বর পাটুলীর পৈতৃক ভিটে ছেড়ে বংশবাটী( তখন বাঁশবেড়িয়া বলা হত না) তে চলে আসেন ৷ সঙ্গে বাংলার নানা স্থান থেকে ব্রাহ্মণ , কায়স্থ , বৈদ্য এবং ক্ষত্রিয় সহ ৩৬০টি পরিবার ৷ আরো আনেন বেশ কিছু যোদ্ধা পাঠান ৷ দত্তরায়দের রাজস্ব প্রদানে খুশী হয়ে ঔরঙ্গজেব
রামেশ্বরের পরিবারকে পঞ্জ -পর্চা খেলাৎ বা পাঞ্জা
প্রতীক দান করেন ৷ বংশানুক্রমে “রাজা মহাশয়”
উপাধি দেন ৷মারাঠা আক্রমণের সময় রামেশ্বর একটি বিশাল বাঁশবন পরিষ্কার করে এক মাইল জুড়ে প্রতিরক্ষা পরিখা তৈরী করেন ৷ রামেশ্বর রায়
১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে অপূর্ব পোড়ামাটি (টেরাকোটার) কারুকার্য খচিত বিষ্ণু মন্দির যা “অনন্ত বাসুদেব মন্দির” বলে পরিচিত নির্মাণ করেন ৷ রামেশ্বরের ছেলে রঘুদেব এবং তাঁর ছেলে
গোবিন্দ দেব ৷ এই গোবিন্দ দেব ও হংসেশ্বরী দেবীর ছেলে হলেন নৃসিংহদেব ৷ গোবিন্দ দেব মারা যাওয়ার তিন মাস পরে নৃসিংহদেবের জন্ম হওয়ায় নবাব আলীবর্দী এনাদের সব সম্পত্তি অন্য
জমিদারদের বন্দোবস্ত করে দিলে এই পরিবার নিদারুন অর্থকষ্টে পরে ৷ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের
পরাজয়ের পরে ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁদের পৈতৃক
জমিদারী ফিরিয়ে দেন ৷ ১৭৫৯ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁদের আরো তিনটি পরগণা দেন ৷
এরপর তখনকার জমিদার বা রাজা নৃসিংহদেব
কাশী চলে যান ৷ ১৭৯২ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত সেখানে তন্ত্র চর্চা করেন ৷ তান্ত্রিক নৃসিংহের বিখ্যাত
তন্ত্র সাধনার ফসল “উড্ডীশতন্ত্র” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ৷ তিনি বংশবাটীতে ফিরে প্রপিতামহের
তৈরী অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের পাশে তন্ত্রমতে একটি মন্দির তৈরীর সিদ্ধান্ত নেন ৷ সেটাই হংসেশ্বরী মন্দির ৷অনন্যসাধারন স্থাপত্যের এই মন্দিরটি সারা বিশ্বে পরিচিত ৷ যা ইম্পিরিয়াল গেজেট সহ বহু সরকারী , বেসরকারী ও ধর্মীয়
গ্রন্থে উল্লেখিত আছে ৷ মন্দিরের নির্মাণ সম্বন্ধে
মন্দির গাত্রের একটি শ্লোক থেকে জানা যায় ৷
“শাকাব্দে রস-বহ্নি-মৈত্রসনিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং /মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং “৷৷/ ভূপালেন নৃসিংহদেব কৃতি নারদ্ধং তদাজ্ঞানুগা ৷/ তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্মমে ৷”
১৮১৪ সালে শেষ হয় নির্মাণ কাজ ৷ রাজস্থান ও উত্তরাখন্ড থেকে পাথর ও শিল্পী এসে মন্দির সর্ম্পূণ করেন ৷ চুনারের পাথরে জয়পুরের শিল্পীরা মন্দিরটি তৈরী করেন বলে রাজস্থানী স্থাপত্য ছাপ দেখা যায় ৷২১ মিটার উঁচু এই মন্দিরে ১৩ টি মিনার যেন হাজার পাপড়ির পাথুরে চূড়া না ফোটা পদ্মের মত ৷প্রতিটি চূড়ার নিচে একটি করে মহাদেব রয়েছেন ৷গর্ভগৃহের উচ্চতা ৭০ ফুট ৷ চূড়ার শীর্ষে মহাদেব ৷ সভাগৃহের মূলধারে কুলকুন্ডলিনী শক্তিরূপী দেবী হংসেশ্বরী
বিরাজমানা ৷ উপনিষদের ভাষ্য অনুযায়ী হংস মানে জ্ঞান বা আলো ৷ হংসেশ্বরী আলোকস্বরূপা ৷
“অহমিতি বীজম্ ৷ স ইতি শক্তিঃ ৷ সোহহমিতি কীলকম্ ৷ মানে , “হং” বীজ , সঃ শক্তি ও সোহং হলো উপায় ৷ তন্ত্র মতে মন্দিরের পাঁচটি তলা মানবদেহের ইড়া , পিঙ্গলা , বজ্রাক্ষ , সুষুম্না ও চিত্রিণী পাঁচ নাড়ীকে বোঝাচ্ছে ৷সহস্রদল পদ্মের উপর ত্রিকোণ বেদী ৷
নিমকাঠের দেবী পঞ্চমুন্ডির আসনে বিরাজমানা ৷ পাথরের শিবের নাভি থেকে বের হয়ে আসা সরু ডাঁটার পদ্মে দেবী বসে আছেন ৷ দক্ষিণাকালীর বীজ হংসেশ্বরী ৷ দক্ষিণাকালীরূপে পূজিতা
দেবী নিমকাঠে তৈরী নীলবর্ণা , ত্রিনয়নী ,চর্তুভূজা ,খড়্গধারিণী ও নরমুন্ডধারিণী ৷ আসলে মায়ের বাঁ দিকের উপরের হাতে খাঁড়া , ঐ নিচের হাতে নরমুন্ড , ডান
দিকের উপরের হাতটি অভয়মুদ্রা ও নিচের হাতে শাঁখ ৷ ষট্ ভেদ যোগের আধারে নির্মীত ৷কুলকুন্ডলিনী শক্তির আধার মা ৷ মন্দিরটি দক্ষিণ মুখী ৷ গঙ্গার অনতিদূরে ৷ মন্দিরের চারপাশে রয়েছে পরিখা ৷ যাকে স্থানীয়রা গড় বলেন ৷মন্দিরের সামনে বিশাল নহবৎখানা ৷২১৫ বছর ধরে নিত্যপুজো হচ্ছে ৷বর্তমানে হংসেশ্বরী ও পাশের অনন্ত বাসুদেব মন্দির ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত ৷ জমিদার বাড়ী সহ ৪৩১ বিঘা জমির উপর তৈরি ৷সকাল ৭টায় মন্দির খোলা হয় ৷বাইরে পুজোর ডালা কিনে পুজো দিতে পারেন ৷ দশটার মধ্যে কুপন নিলে টাকা দিয়ে মায়ের ভোগ খাওয়া যায় ৷ প্যাক করে নিয়ে আসা রায় ৷ দুপুরে সাড়ে বারোটা থেকে মা বিশ্রাম নেন ৷ তখন বিগ্রহ দেখা যায় না ৷ বিকাল চারটেয় আবার খোলা হয় ৷ সন্ধ্যায় আরতির পরে ৭টায় মন্দির বন্ধ হয় ৷বাৎসরিক পুজো হয় রথের স্নান
যাত্রার দিন ৷ প্রতিবছর কালীপুজোর রাতে কালীর মুখোস পড়িয়ে এলোকেশী রূপে হংসেশ্বরী মাকে মুক্তোকেশী রূপে পুজো করা হয় ৷ এই দিন জিহ্বা প্রকাশিত রূপোর মুখোস পরিয়ে মুক্তোকেশীর ধ্যানে পুজো করা হয় ৷ জয় মা হংসেশ্বরী !
” নমঃ মহিষাগ্নি মহামায়ে চামুন্ডে মুন্ডমালিনী ৷
আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোস্তুতে ” !