‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ (Lokah Chapter 1: Chandra) হলো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ভারতীয় মালয়ালম ভাষার সুপারহিরো চলচ্চিত্র। এটি শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়, এটি কেরালার স্থানীয় লোককথা ও পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে ব্যবহার করে তৈরি একটি বৃহত্তর ‘লোকাহ সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স’ (LCU) এর সূচনা।
🎥 লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা: ভারতীয় লোককথায় সুপারহিরোর আগমন
— এক নতুন সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের সফল যাত্রা
১. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ চলচ্চিত্রটি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি হলো মালয়ালম সিনেমার প্রথম মহিলা-নেতৃত্বাধীন সুপারহিরো ব্লকবাস্টার। প্রখ্যাত অভিনেতা দুলকার সালমান-এর প্রযোজনা সংস্থা ওয়েফারার ফিল্মস-এর অধীনে নির্মিত এই সিনেমাটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন ডমিনিক অরুণ। কেরালা এবং সমগ্র ভারতে বক্স অফিসে রেকর্ড সৃষ্টি করে এই ছবিটি সর্বোচ্চ আয়কারী মালয়ালম চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
২. মূল চরিত্র এবং কলাকুশলী
এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ‘চন্দ্রা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কল্যাণী প্রিয়দর্শন (Kalyani Priyadarshan)। তার রহস্যময় এবং শক্তিশালী চরিত্রটি দর্শক ও সমালোচক উভয়ের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসলেন কে. গফুর (Naslen K. Gafur), স্যান্ডি মাস্টার (Sandy Master) এবং অরুণ কুরিয়ান (Arun Kurian)।
প্রযোজক হিসেবে দুলকার সালমান এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রখ্যাত অভিনেতা মামুট্টির (Moothon চরিত্রে) উপস্থিতি সিনেমাটির আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে।
৩. কাহিনীর পটভূমি: পৌরাণিক জগৎ ও আধুনিকতা
চলচ্চিত্রটির গল্প ভারতীয়, বিশেষ করে কেরালার স্থানীয় লোককথা (Folklore) এবং মিথোলজি-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সিনেমাটি শুরু হয় এক অগ্নিময় দৃশ্যের মধ্য দিয়ে, যেখানে চন্দ্রা নামের এক রহস্যময়ী মহিলাকে দেখা যায় যিনি সাধারণ মানুষ নন, বরং তার মধ্যে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো এক শক্তি।
গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে চন্দ্রা, যে কেরালার এক শক্তিশালী লোককথা চরিত্র কাল্লিয়াঙ্কট্টু নীলি (Kalliyankattu Neeli)-এর সাথে সম্পর্কিত। এক গোপন মিশনের কারণে চন্দ্রা বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে একটি ক্যাফেতে নৈশ শিফটে কাজ শুরু করে। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ জীবন যাপন করলেও, সে শীঘ্রই বেঙ্গালুরুর আন্ডারওয়ার্ল্ডের অঙ্গ পাচারকারী চক্র (Organ Trafficking Gang)-এর সাথে জড়িয়ে পড়ে, যার পেছনে রয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ অফিসার ইন্সপেক্টর নাচিয়াপ্পা গৌড়া (Inspector Nachiyappa Gowda)।
৪. সুপারহিরোর জন্ম ও বিশ্ব-নির্মাণ
সিনেমাটির প্রধান শক্তি হলো এর বিশ্ব-নির্মাণ (World-Building)। পরিচালক ডমিনিক অরুণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চিরাচরিত লোককথাকে আধুনিক সুপারহিরো ঘরানার মোড়কে পেশ করেছেন। এটি শুধুমাত্র একটি একক গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি বৃহত্তর ‘লোকাহ ইউনিভার্স’ তৈরির ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কেরালার কিংবদন্তি চরিত্র যেমন— চাতান (Goblin) এবং ওড়িয়ান (Odiyan)-এর মতো চরিত্রদের আবির্ভাব ঘটে।
কাহিনীর মোড়ে চন্দ্রা তার আসল পরিচয় জানতে পারে এবং তার ভেতরের অতিপ্রাকৃত শক্তিকে ব্যবহার করে অন্যায় ও পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এটি ভারতের পুরুষ-শাসিত সুপারহিরো ঘরানায় একজন শক্তিশালী নারী চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৫. প্রভাব ও উপসংহার
‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’ সিনেমাটি সমালোচকদের দ্বারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করলেও, এর উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা, অসাধারণ চিত্রগ্রহণ (Cinematography) এবং জেকস বিজয়ের (Jakes Bejoy) দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সকলের নজর কেড়েছে। এটি মালয়ালম সিনেমায় একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতি ও পৌরাণিক গল্পকে বিশ্বমানের সিনেম্যাটিক রূপে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম।
সর্বোপরি, এই চলচ্চিত্রটি প্রমাণ করেছে যে আঞ্চলিক শিল্পীরাও বৃহত্তর আঙ্গিকে এবং আন্তর্জাতিক মানের সুপারহিরো ঘরানার সিনেমা তৈরি করার সাহস এবং ক্ষমতা রাখেন। এটি দর্শকদের মধ্যে পরবর্তী ‘লোকাহ’ চ্যাপ্টারের জন্য প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, যেখানে আরও বৃহত্তর একটি পৌরাণিক জগত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়।
লোকাহ সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স: পরবর্তী অধ্যায় ও পৌরাণিক চরিত্র
‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’-এর শেষে এবং পোস্ট-ক্রেডিট দৃশ্যে এমন কিছু চরিত্রের আগমন দেখানো হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে নির্মাতারা কেরালার লোককথার ওপর ভিত্তি করে একটি বিস্তৃত ইউনিভার্স গড়তে চাইছেন।
১. দ্য ওড়িয়ান: চার্লি (Charlie)
চন্দ্রার গল্প শেষ হওয়ার পর, একটি পোস্টেড-ক্রেডিট দৃশ্যে অভিনেতা দুলকার সালমান (যিনি এই ছবির প্রযোজকও) চার্লি নামে একটি চরিত্রে উপস্থিত হন।
- চরিত্রের পরিচয়: চার্লিকে একজন রহস্যময়, নিনজা-সদৃশ রূপে দেখানো হয়েছে, যিনি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের বাকি সদস্যদের নির্মূল করছেন। তাকে ওড়িয়ান (Odiyan) বলে মনে করা হয়।
- পৌরাণিক ভিত্তি: ওড়িয়ানরা কেরালার লোককথায় খুব পরিচিত এক কিংবদন্তি চরিত্র। এদেরকে রূপ পরিবর্তনকারী (Shapeshifter) হিসেবে বিশ্বাস করা হয়, যারা রাতের অন্ধকারে পশুর রূপ ধারণ করে মানুষদের ক্ষতি করতে পারে।
- ইউনিভার্সে ভূমিকা: চার্লি সম্ভবত এই ইউনিভার্সের একজন ভালো শক্তি বা অভিভাবক (Guardian) হিসেবে কাজ করবে, যার নিজস্ব ক্ষমতা এবং কোড অফ কন্ডাক্ট আছে।
২. দ্য চাতান: মাইকেল (Michael)
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে অভিনেতা টোবিনো থমাস (Tovino Thomas)-কে একটি চরিত্রে দেখা যায়, যার নাম সম্ভবত মাইকেল (Michael)।
- চরিত্রের পরিচয়: মাইকেলকে অনেকটা গবলিন-সদৃশ (Goblin-like) বা কিছুটা জাদুকরী শক্তিসম্পন্ন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
- পৌরাণিক ভিত্তি: মাইকেল চরিত্রটি কেরালার লোককথার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্তা ‘চাতান’ (Chathan)-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি। চাতানরা হলো এক ধরনের ছোট দুষ্ট আত্মা বা দৈত্য, যাদের সাধারণত অশুভ শক্তি হিসেবে দেখা হলেও, অনেক সময় মানুষকে সাহায্য করার ক্ষমতাও এদের থাকে।
- ইউনিভার্সে ভূমিকা: চাতান সম্ভবত এমন একটি চরিত্র হবে যার নৈতিকতা ধূসর (Grey), যা ইউনিভার্সের গল্পকে আরও জটিল করে তুলবে।
৩. দ্য সুমনের (The Summoner): মূথন (Moothon)
যদিও এই চরিত্রটি প্রথম অংশেই উপস্থিত ছিল, এর রহস্য পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে খুলতে পারে।
- চরিত্রের পরিচয়: এটি একটি ছায়াময় চরিত্র, যার কণ্ঠস্বর দিয়েছেন অভিনেতা মামুট্টি (Mammootty)। এই চরিত্রটিই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অতিপ্রাকৃত শক্তিধর মানুষদের ডেকে পাঠায়।
- ইউনিভার্সে ভূমিকা: মূথন (Moothon) হলো সেই উচ্চতর সত্তা, যিনি এই বিশেষ ক্ষমতাযুক্ত মানুষদের একত্রিত করে পৃথিবী এবং পৌরাণিক ভারসাম্যের রক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে এই মূথনের আসল উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতা প্রকাশ পেতে পারে।
🔮 ভবিষ্যতের প্লটের সম্ভাব্য ইঙ্গিত
ধারণা করা হচ্ছে, লোকাহ ইউনিভার্সের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে এই ভিন্ন ভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রদের মধ্যে জোট (Alliance) এবং সংঘাত (Conflict) দেখা যাবে।
- Lokah Chapter 2: Odiyn/Charlie: দ্বিতীয় অধ্যায়টি সম্ভবত দুলকার সালমানের ‘ওড়িয়ান’ চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে পারে, যেখানে তার উৎপত্তি এবং ক্ষমতা বিস্তারিতভাবে দেখানো হবে।
- দ্য গ্রেটার থ্রেট: যেহেতু ‘চন্দ্রা’ সিনেমাতে ভিলেন হিসেবে শুধুমাত্র অঙ্গ পাচারকারী চক্রকে দেখানো হয়েছিল, তাই পরবর্তী সিনেমাগুলিতে সম্ভবত আরও শক্তিশালী, পৌরাণিক ভিলেন বা দানবের আগমন ঘটবে যারা এই লোকাহ ইউনিভার্সকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে।