রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বিজ্ঞান চেতনা
উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিশ শতকে প্রথমপাদে যেসব বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তােলার উদ্দেশে বিজ্ঞানের লেখালেখিতে আত্মনিয়ােগ
করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯) বঙ্কিমচন্দ্রের পরে রামেন্দ্রসুন্দর যখন কলম ধরেন তখন বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্যে অন্যতম নবযুগের সূচনা হয়। তিনি ছিলেন বিশাল
মাপের বিজ্ঞান-চিন্তক, খ্যাতিমান লেখক, সমাজসেবী, দর্শন ও সাহিত্যবেত্তা,
স্বদেশপ্রেমী এবং সমকালে অতিসম্মানিত প্রজ্ঞাযুক্ত রসায়নশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানের
অধ্যাপক।
১৮৮৫ সালে বি.এ. পরীক্ষায় রামেন্দ্রসুন্দরের রসায়নশাস্ত্রের খাতা দেখে সেকালের বিখ্যাত রসায়নের প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক পেডলার মন্তব্য করেন—“আমি এ যাবৎ যত।
রসায়নের কাগজ দেখিয়াছি তন্মধ্যে ও-ই out and out the best.” ১৮৮৭ সালের এম.এ পরীক্ষায়ও রামেন্দ্রসুন্দর প্রথম স্থান অধিকার
করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৮৮৮সালের প্রেমাদ রায়চাদ ছাত্রবৃত্তির অধিকারী রামেন্দ্রসুন্দরের পরীক্ষকদের মন্তব্য ছিল, ‘The candidate who took up Physics and Chemistry is perhaps
the best student that has yet taken up these subjects at this eximatuion.’ অর্থাৎ প্রেমাদ রায়চাঁদ পরীক্ষায় এ-পর্যন্ত যে-সকল ছাত্র পদার্থবিদ্যায় ও রসায়নশাস্ত্র নিয়েছেন, এই ছাত্রই তাঁদের মধ্যে বােধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ। এ কেবল মুর্শিদাবাদের কান্দির
প্রত্যন্ত জেনাে গ্রামের এক পিতৃহীন যুবকের মেধার স্বীকৃতি নয়,বিজ্ঞানসেবক এক প্রজ্ঞাবান মানুষের মননের বিচ্ছুরণমাত্র।রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান শুধু তথ্যসর্বস্ব বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান ছিল তার
কাছে পরম আনন্দের বিষয়, উপভােগ এবং অনুশীলনের সামগ্রী।
অল্প বয়সেই গণিতশাস্ত্রে রামেন্দ্রসুন্দরের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সেকালে প্রথানুসারে বালককে আট বছর
বয়সেই জ্যামিতি অধ্যয়ন করতে হতাে। অল্পবয়স্ক বালকদের কাছে। জ্যামিতিশাস্ত্র ছিল অতি বিভীষিকার বিষয়। বালক রামেন্দ্রসুন্দর দু-বছরের মধ্যেই জ্যামিতির প্রথম খণ্ডের যাবতীয় অনুশীলনী সমেত প্রতিজ্ঞাগুলির নির্ভুলভাবে সমাধান করেন এবং পাটীগণিত ও শুভঙ্করী সংক্রান্ত সকল সমস্যাগুলাের অনায়াসে মীমাংসা করেন।
স্কুলজীবনে পাঠ্যবই ছাড়াও বহু বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন রামেন্দ্রসুন্দর। প্রথমে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। পরে নবীনচন্দ্র দত্তের ‘খগােল। বিবরণ পড়ে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহশীল
হয়ে ওঠেন এবং তিনি নিবিড়ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠে মনােনিবেশ করেন।
উত্তরজীবনে রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞান গবেষণায় না থেকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হন। এবং সারা জীবন জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় নিজেকে নিয়ােজিত করেন। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দরের হাতেখড়ি হয় ‘নবজীবন’ পত্রিকায়। ২০ বছর বয়সে বি.এ. ক্লাসে পড়াকালে তার প্রথম বিজ্ঞান
বিষয়ক প্রবন্ধ ‘মহাশক্তি’ প্রকাশিত হয়। (১২৯১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়)। যে
পত্রিকায় লিখতেন বঙ্কিমচন্দ্রচট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র দত্ত, ইন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যয় প্রমুখ মনীষীরা। মহাশক্তি’ প্রবন্ধের কিছুটা অংশ—
“কে বলিবে এ ব্রহ্মাণ্ড কার রচিত? কে জানে এ ব্রহ্মাণ্ড কী?
এই পরিদৃশ্যমান অনন্ত জগৎ সীমাহীন, পরিধিহীন অনন্ত
আকাশে অনন্তকাল ভ্রাম্যমান—কে আমাকে বলিবে উহা কী ?
প্রাচীন বৈদান্তিক বলেছেন, ইহা মায়া; আধুনিক বৈজ্ঞানিক
বলেন, ইহা অজ্ঞেয়। বিজ্ঞান ও দর্শনের একমাত্র উত্তর আমি
জানি না।”
তারপর ‘নবজীবন’ পত্রিকায় তার আরও কয়েকটি বৈজ্ঞানিক
3 প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেমন ‘মহাতরঙ্গ’ (অগ্রহায়ণ, ১২৯২),
‘জড়জগতের বিকাশ’ (আষাঢ়, ১২৯৩), ‘সৃষ্টিতত্ত্ব (শ্রাবণ, ১২৯৩)প্রভৃতি। নবজীবন’ ছাড়া সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘দাসী’, ‘সাহিত্য,
‘মানসী’, ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’, ‘মুকুল’, ‘উপাসনা’, ‘আর্যাবর্ত’প্রভৃতি সমকালের প্রায় সব পত্রিকাতেই তার বিজ্ঞান ও সাহিত্য
বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সাধনা’ সহ অন্যান্য পত্রিকায় তার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকৃতি প্রকাশিত হয়
১৯০৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন (১৮৯৬ সালের ৭ অক্টোবর)। প্রকৃতি’ গ্রন্থ
যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি তার বিজ্ঞাপনে লেখেন—
বাংলা ভাষায় সাধারণ পাঠকের নিকট বিজ্ঞান প্রচার বােধহয় অসাধ্য সাধনের চেষ্টা। সিদ্ধিলাভের ভরসা করি না। আরও
লেখেন, পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের আয়াসলব্ধ বৈজ্ঞানিক সত্যগুলি মানবজাতির সাধারণ সম্পত্তি; আমাদের ঋণগ্রহণ
ভিন্ন গত্যন্তর নাই।
‘প্রকৃতি’তে সঙ্কলিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে সৌরজগতের উৎপত্তি,
‘আকাশতরঙ্গ’, ‘পৃথিবীর বয়স’, ‘জ্ঞানের সীমানা’, ‘প্রকৃত সৃষ্টি, ‘প্রকৃতির মূর্তি’, “ক্লফোর্ডের কীট’, ‘প্রাচীন জ্যোতিষ’, ‘আর্যজাতি’ প্রভৃতি রচনায় আগাগােড়া বিজ্ঞানেরই কলধ্বনি শােনা যায়।
‘সৌরজগতের উৎপত্তি’ প্রবন্ধে সৌরজগতের উৎপত্তি বিষয়ে
সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া আছে। “জ্ঞানের সীমানা প্রবন্ধ বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লিখিত হলেও তাতে দার্শনিকতার ছাপ আছে। প্রবন্ধের শেষাংশে বলেছেন-
‘জড়জগতের অস্তিত্ব কল্পনামাত্র। এই কল্পনা জীবনরক্ষায় একটা উপায় বা কৌশল। প্রকৃতি করাইতেছে, তাই
যথানিযুক্তবৎ করিতেছি।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক কোনাে তথ্যকেই তিনি যুক্তি ও প্রমাণ ভিন্ন মেনে নেননি।
আমি বৈজ্ঞানিকতার স্পর্ধা রাখি না; কিন্তু আমি বৈজ্ঞানিকতাজীবী বিজ্ঞানভিক্ষু। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষালব্ধ প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভিন্ন অন্য প্রমাণ ব্যবহারিকবিদ্যায় আমার নিকট অগ্রাহ্য।
কিন্তু এরই সঙ্গে তিনি এমন কথাও বলেছেন-
যিনি জগতের এতগুলি আঁধার কুঠুরির মধ্যে প্রাচীর ভাঙ্গিয়া আলােকিত প্রবেশপথ বাহির করিয়াছেন, হয়তাে তাঁহার কাছেই ইহার উত্তর পাইব।
‘পৃথিবীর বয়স প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর জীববিজ্ঞান ভৌতবিজ্ঞানের পরস্পরবিরােধী চৈতন্যের মধ্যে সহঅবস্থানের একটি ভিত্তি দাঁড় করাতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিন বলেছেন-
আশা করা যায় অচিরকালের মধ্যেই ভূ-বিদ্যাও জীববিদ্যার প্রতিপক্ষে দণ্ডায়মান পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার সহিত একটা বন্দোবস্ত করিয়া মিটমাট করিয়া ফেলিবে। আমরা তখন জননী
বসুন্ধরার বয়সের তথ্য কতকটা নিঃসংশয়ে জানিতে পারিয়া
আশ্বস্ত হইব।
‘ক্লফোর্ডের কীট প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ সরস মন্তব্য করেছেন-
প্রকৃতিমাতার বহু যত্নে লালিত ও বহু যুগের প্রয়াসে গঠিত ও
পুষ্ট মানুষের এই তনুখানি এত সহজে ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক অঙ্গরা বায়ুতে পরিণত হইতে দেখিয়া প্রকৃতিমাতা কাঁদেন না হাসেন বলিতে পারি না।
‘প্রকৃতির মূৰ্ত্তি’ প্রবন্ধে প্রকৃতি যেভাবে প্রতীয়মান হয় তার রূপ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতির প্রত্যক্ষময় ও ইন্দ্রিয়বােধ জগৎ
সম্বন্ধে তিনি বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।
‘প্রাচীন জ্যোতিষ’ নামের দুটি প্রবন্ধে তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের মূল কথা বিবৃত করেছেন। প্রকৃতি গ্রন্থের সর্বশ্রে প্রবন্ধ প্রলয়। প্রবন্ধের শুরু কল্পকাহিনি দিয়ে হলেও প্রলয় সম্পর্কে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক আলােচনা করেছেন। বৈজ্ঞানিক রামেন্দ্রসুন্দরের মনীষার পরিচয় পাওয়া যায় জগৎ ও জীবনের প্রতি অপরিসীম কৌতূহলে। জগৎ ও
জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য যে ঐকান্তিক আগ্রহ যুগে যুগে মানুষের বস্তু সংক্রান্ত চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে সেই ঐতিহ্যকে স্বীকার করা যে প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের কাজ সে সম্পর্কে কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এ প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দরের মন্তব্য স্মরণযােগ্য আমার বিবেচনায় যাঁহারা আধুনিক বিজ্ঞানের সহিত প্রাচীন
বিজ্ঞানের এইরূপ সমন্বয় করিতে চান, তাহারা একটা ভুল করেন। বিজ্ঞানবিদ্যাটাই পরিবর্তনশীল; উন্নতিশীল বলিতে চাও ক্ষতি নাই। উহার সিদ্ধান্তগুলি ক্রমশ পরিবর্তিত ও
পরিণত হইতেছে। বিজ্ঞান কোনােদিন একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারে না; আজ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে কাল সে সিদ্ধান্ত বদলাইয়া যাবে। ইহাতে সে লজ্জিত নহে; বরং বিজ্ঞান জানে যে, ইহাই তাহার মাহাত্ম্য। (প্রকৃতি)
‘প্রকৃতি’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১২ বছর পরে ১৩১৫ বঙ্গাব্দ ফাল্গূনে (৮ মাছ, ১৯০৯) গ্ৰন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। হেরম্যান হলমহোলৎজ প্রবন্ধ বর্জিত ও দুটি
নতুন প্রবন্ধ ‘আলােকতত্ত্ব’ ও ‘পরমাণু’ প্রকাশিত হয়।
হয়। এই সংস্করণে (হেরম্যান মহােলজ’ প্রবন্ধটি বর্জিত ও দুটি।
বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (৮ মার্চ, ১৯০৯) গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত।
‘প্রকৃতি’ গ্রন্থের প্রকাশের সাত বছর পরে ১৩১০ বঙ্গাব্দে (১৬মার্চ, ১৯০৪) রামেন্দ্রসুন্দরের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়।
প্রথম সংস্করণের নিবেদনে লেখক বলেছেন—“বিবিধ মাসিকপত্রে।
প্রকাশিত আমার দার্শনিক প্রবন্ধগুলি এই গ্রন্থে সংকলিত হল।”
ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর জিজ্ঞাসা’কে দর্শনের গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত
করলেও এর বেশিরভাগ প্রবন্ধের অবয়ব বিজ্ঞান। বস্তুত বিজ্ঞান এবং দর্শন গ্রন্থটির অধিকাংশ প্রবন্ধের মধ্যে একাকার হয়ে গেছে।
সত্যিকথা বলতে কী, রামেন্দ্রসুন্দর এ গ্রন্থে বিজ্ঞান এবং দর্শন—উভয় বিদ্যাকেই আশ্রয় করে জগত্রহস্যের উত্তর খুঁজেছেন। উত্তর যে তার সব মিলেছে তা নয়, কিন্তু নিরন্তর তঁার চেষ্টা চলেছে। তার কাছে
সত্য ছিল আপনার বা নিজের অস্তিত্ব। এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই।
‘সত্য’ প্রবন্ধে তিনি সেকথাই বলেছেন।
‘আমি আছি ইহা অপেক্ষা সত্য আর নাই। যাবতীয় বিজ্ঞানের প্রথম স্বতঃসিদ্ধ এই। জীবনযাত্রার আরম্ভ এই সত্যে বিশ্বাসে।
যদি কোনও সত্যকে নিরপেক্ষ ধ্রুব সত্য বলিতে হয়, তাহা এই সত্য। বস্তুতই ইহা পারমার্থিক সত্য।’
রামেন্দ্রসুন্দর যে আমি’-র অস্তিত্বকে পারমার্থিক সত্যরূপে গ্রহণ করেছেন, সে আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ছােটো আমি,
শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় ‘কাচা আমি। সত্য প্রবন্ধে আমার অস্তিত্ব বিষয়ে সেকথা বলা হয়েছে সেই অস্তিত্বের অর্থ বােঝা যায় ‘জগতের অস্তিত্ব’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা
করেছেন। জগৎকে বিশ্লেষণ করলে মােটামুটি দুটি অংশ পাওয়া যায়।
এর প্রথমটি ‘আমি’ এবং দ্বিতীয় ‘আমি-ছাড়া। ‘আমি’ শব্দটির অর্থ
এখানে সেই যে অনুভব করে, চিন্তা করে, ইচ্ছা করে, অনুভূতি, চিন্তা, কামনা, ইহা যদি চৈতন্যের লক্ষণ বলা যায়, তবে আমি অর্থে আমার মধ্যে যে চেতন। আমি-ছাড়া কী রইল? চেতনা আমাকে বাদ দিয়ে জগতের অবশিষ্টাংশ। সেই অর্থে বাইরের জড়জগৎ এবং
আমার ভৌতিক শরীর পর্যন্ত আমার বাইরে। তাহলে ‘জগতের অস্তিত্ব বলিলে আমার অস্তিত্ব ও আমার বহিঃস্থ এই জগতের অস্তিত্ব, এই দুই বুঝিতে হইবে।
বিজ্ঞান এবং দর্শনের এ-জাতীয় একত্রীকরণের অনেক নমুনা
পাওয়া যায় রামেন্দ্রসুন্দরের রচনায়। বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানও দর্শনের যে সমন্বয় রামেন্দ্রসুন্দরের রচনায় দেখা যায় তা এককথায় অভূতপূর্ব।
‘সৃষ্টি’ প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বৈজ্ঞানিক মতবাদে নির্মাণ ঘটিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
বিজ্ঞান যাহাকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে, যাহাকে তােমরা দর্শনের ইচ্ছার বিকাশ বলিতেছ, তাহারই দ্বারা জগতের নির্মাণ প্রণালী ও ক্রিয়া প্রণালী সংগতভাবে বুঝিবার চেষ্টা হইতেছে। কীরূপে হইতেছে তাহার উত্তর বিজ্ঞানের নিকট মিলিতে
পারে। বিজ্ঞানচর্চায় রামেন্দ্রসুন্দরের নিষ্ঠা কখনও স্তিমিত হয়নি। সংশয় এসেছে মাঝে মাঝে, তবুও অযথার্থ জ্ঞানের সঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দরের কখনও কোনাে ধরনের আপস রফা হয়নি। বৈজ্ঞানিক চেতনাকে
ক্ষুরধার করার জন্য তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে চেয়েছেন তা যথাযথ কিনা তার বিচারবিশ্লেষণ তিনি করেছেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকে কখনও বিরত হননি। যেমন, কোষ্ঠীবিচারে
কোনাে বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আছে কিনা সে সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দর ‘ফলিত জ্যোতিষ’ প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা জানি, শােষিত, বিপর্যস্ত ও প্রতারিত মানবমানবী কোষ্ঠীফলের যৌক্তিকতা সম্পর্কে।
বহু ক্ষেত্রে মানসিকভাবে দোদুল্যমান। তবে কোনাে ধরনের রূঢ়তা।
প্রকাশ না করে তিনি যে টিপ্পনি কেটেছেন তার জ্বালা কোষ্ঠীধারীরা
উপলব্ধি করবেন কিনা বলতে পারা যাবে না, তবে কোষ্ঠীবিচারীরা হাড়ে হাড়ে এই খোঁচার জ্বালা অনুভব করবেন :
বৈজ্ঞানিকরা সহস্র পরীক্ষাগারে ও মানমন্দিরে যে রীতিতে, ফলাফল গণনা ও প্রকাশ করিতেছেন, সেই রীতি আশ্রয় করিতে হইবে। কেবল নেপােলিয়নের ও বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী
বিচার করিলে অবিস্মরণীয় বিশ্বাস জন্মিবে না। চন্দ্রের আকর্ষণে গঙ্গার জোয়ার ভাটা হয়, তবে রমাকান্তের জজিয়তি কেন হইবে না, এরূপ যুক্তিতে চলিবে না।
‘জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থের প্রবন্ধ গুলি সম্পর্কে যােগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মন্তব্য করেছেন।
তাহার জিজ্ঞাসা’ প্রবন্ধগুলি পড়িলে মনে হয় তিনি প্রকৃতির বিজ্ঞান হইতে সার সংগ্রহে আনন্দ পাইতেন। তিনি যখন এই
সকল প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, তখন এই বিষয়ই বৈজ্ঞানিকদের চিত্ত অধিকার করিয়াছিল। কেহ কেহ মনে করিয়াছেন বিজ্ঞান বুদ্ধি বিজ্ঞানের পরিণতি। রামেন্দ্রসুন্দরেও বিজ্ঞানই দর্শনের প্রথম সােপান এবং দর্শনই বিজ্ঞানের পরিণতি। রামেন্দ্রসুন্দরে বিজ্ঞান ও দর্শনের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়াছিল।
‘প্রকৃতি এবং জিজ্ঞাসা’ রামেন্দ্রসুন্দরের জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত গ্রন্থ। কিন্তু তার অন্য দুটি বিজ্ঞানগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার
মৃত্যুর পরে। বিচিত্রজগৎ’ গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯২০ সাল।
‘জগত্ত্বথা প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। বিচিত্রজগৎ’-এর সব।
প্রবন্ধই পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতবর্ষ পত্রিকায় (১৩২১-২৫)।
‘ভারতকথা’-র কিছু অংশ সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত। ‘সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হয়। ‘বিচিত্রজগৎ’ গ্রন্থে রামেন্দ্রসুন্দরের চিন্তার ক্রমপরিণতি লক্ষ করা যায়। জগৎ বিচিত্র। বিজ্ঞানবিদ্যায় বাহ্যজগৎ নিয়ে শুরু করেছেন, যেখানে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছেন, “Physical Science- কেই বাংলায় আমি বিজ্ঞানবিদ্যা বলিব।” এবং বিজ্ঞানবিদ্যায় আলােচ্য বাহ্যজগৎ জনসাধারণের কাছে ততটুকুই যেটা কেবল প্রত্যক্ষ বিষয়। বিজ্ঞানবিদ্যার কাজ বাহ্যজগতের বিবরণ পেশ করা। কোন্ জিনিসটা কেমন, এক জিনিসের সঙ্গে অন্য জিনিসের কী সম্বন্ধ, কোন ঘটনা কীভাবে ঘটে, এক ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার কী যােগ—বিজ্ঞানচিন্তা সে দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাবে। বিজ্ঞানবিদ্যায় বাহ্যজগতের আলােচনায় রামেন্দ্রসুন্দর দু-ধরনের জগতের কথা বপলেছেন। এক, ব্যবহারিক জগৎ; দুই. প্রাতিভাসিক জগৎ। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন কাজ চালাবার জন্য যে জগৎ
মেনে নেয় রামেন্দ্রসুন্দর তাকেই ব্যবহারিক জগৎ বলেছেন। ব্যবহারিক জগৎ হল কোটি কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ দৃষ্ট জগতের গড়।
কিন্তু এই গড় নির্ণয় করা সহজ নয়। কিন্তু মােটামুটি যে গড় নির্ণীত যা হয় তাকে অবলম্বন করেই বৈজ্ঞানিক তার আলােচ্য বৈজ্ঞানিক জগৎ খাড়া করেন। ব্যবহারিক জগৎ একটা তাত্ত্বিক জগৎ মাত্র। কিন্তু প্রত্যেক পদ্ধতিরই প্রতিভাসিক জগৎ স্বতন্ত্র। অর্থাৎ পৃথিবীতে যত মানুষ প্রতিভাসিক জগৎও তত। তাহলে যাকে ব্যবহারিক জগৎ বলা হচ্ছে তা বহু সংখ্যক প্রতিভাসিক জগতের একটা কল্পিত গড় মাত্র। এই ব্যবহারিক জগৎ বৈজ্ঞানিকেরই মনগড়া। সে জগতে নিজস্ব অভিজ্ঞতার মূল্য নেই। স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সাধারণ মানুষের দৃষ্ট অভিজ্ঞতা থেকেই রামেন্দ্রসুন্দর জগতের নানা বিশেষণ ব্যবহারিক জগৎ, বাঙ্ময় জগৎ, জড়জগৎ, প্রাণময় জগৎ, চঞ্চলজগৎ। বিচিত্র জগৎ’ গ্রন্থের বিভিন্ন
প্রবন্ধে জগতের এইসব দিকগুলি নিয়ে আলােচনা করে তিনি
জগৎপ্রবাহের গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন, বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত বিশ্বজগৎকে ঐক্যের বাঁধনে বাঁধতে পারেনি।
প্রত্যেকটি জগতে বিজ্ঞানবিদ্যার ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখেছেন,
সেখানে ফাঁক আছে, ফারাক আছে, স্ববিরােধী তত্ত্ব আছে।বিজ্ঞানবিদ্যার ফাকি ধরা পড়ে প্রতিটি জগতে। ‘বিচিত্রজগৎ’-এ ‘প্রজ্ঞার জয়’ প্রবন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর লেখেন—
ইতর জীবের হস্তে এই প্রজ্ঞাস্ত্র নাই। মানুষ ইহার উদ্ভাবন করিয়াছে। আপনার অভিজ্ঞতার সহিত বর্তমানকে ও ভবিষ্যৎকে যােগসূত্রে আবদ্ধ করিয়াছে এবং বর্তমান ও
ভবিষ্যৎ উভয় ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিচালিত করিয়া অসীম সামর্থ্য লাভ করিয়াছে। এই প্রজ্ঞার অস্ত্র বিজ্ঞানময় অস্ত্র।
বিজ্ঞান-দার্শনিক রামেন্দ্রসুন্দর বলেছেন-
বৈজ্ঞানিক এই বিজ্ঞানাস্ত্র প্রয়ােগ করিয়া বাঞ্ছয় জগৎ নির্মাণ করিয়াছেন এবং বাঙ্গয় জগতের অনুশাসনে প্রত্যক্ষ জগৎকেও
আপনার বশীভূত করিয়াছেন। বিজ্ঞানবিদ্যার এই জন্য এত স্পর্ধা। মানুষের কারবার প্রত্যক্ষ জগতে। প্রজ্ঞাবলে সেই প্রত্যক্ষ জগৎ মানুষের বশীভূত। প্রজ্ঞাবান মানুষ জগতের প্রভু,
অতএব প্রজ্ঞারই জয়।‘জগকথা’ গ্রন্থে ৭৫টি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলিত।
গ্রন্থটির প্রস্তাবনা প্রবন্ধ ‘জড়জগৎ’-এ তিনি বলেছেন-
জড় শব্দটি আমাদের প্রাচীন দর্শনশাস্ত্র হইতে গৃহীত। সেই প্রাচীনশাস্ত্রে যাহা চেতন নহে, তাহাকেই জড় বলিত। জগতে এমন একজন কেহ আছেন, তিনিই ‘আমি’; আর যাহা কিছু আছে তিনিই অর্থাৎ সেই ‘আমি’ই আমার জ্ঞাত। নব প্রাকৃতিক নিয়ম নতুন জ্ঞানকে জানতে ও জ্ঞানের সােপানে আরােহন করতে সহায়তা করে। তিনি বলেছেন-
কোন দিকে চলিতে চলিতে নতুন তথ্যের সন্ধান জানিব। সেই
পথ দেখায়।…
‘জগৎকথায় তিনি জগৎকে দেখেছেন জড়বাদী বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টি দিয়ে। তবু বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা এসেছে মাঝে মাঝে। তিনি বলেছেন, ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার একটা সীমা আছে। মানুষ বুদ্ধি
খাটিয়ে সে সীমাকে যতই দূরে ঠেলে নিয়ে যাক, যন্ত্র দিয়ে তাকে যতই স্বাকার্যসাধনে সমর্থ করে তুলুক, সে সীমা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌছাবে বলা কঠিন। কাজেই বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ; কিন্তু ইহার
গতি সম্পূর্ণতার অভিমুখে; সম্পূর্ণ কখনও হইবে না, তবে সম্পূর্ণতার অভিমুখে ক্রমশ চলিতেছে এবং আশা করা যায় সে চলিবে। (পরিমাণ সমস্যা) প্রকৃতিবিজ্ঞানের বস্তুবাদী ঐতিহ্যকে স্বীকার করে জ্ঞানান্বেষণের
কাজে অগ্রসর হতে চেয়েছেন বলেই রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞানচেতনা সংহত, পরিচ্ছন্ন ও সৃষ্টিশীল। বৈজ্ঞানিক অন্বেষার ব্যাপ্তি ও গভীরতা রামেন্দ্রসুন্দরকে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথায় : “যারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে শিখেছেন, তাদের মধ্যে সকলেই বৈজ্ঞানিক—একথা যে আমি মােটেই মনে করি না। যাঁদের মধ্যে সত্যিসত্যিই বৈজ্ঞানিক মানসিকতা জীবন্ত আমি তাদেরই
বৈজ্ঞানিক বলতে পারি।”
তথ্যসূত্র:-
১. এম.এ. আজিজ মিয়া, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী: জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, বঙ্গীয়
বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা
অরূপরতন ভট্টাচার্য, বাঙালির বিজ্ঞানভাবনা ও সাধনা, অরূপরতন
ভট্টাচার্য, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা
৩. অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী: বিজ্ঞানভাবনা,
বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি, কলকাতা
৪, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (স.), রামেন্দ্র
রচনাবলী, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা