মহিসাদল রাজবাড়ী একদিনের বেড়ানো
সে অনেক কাল আগের কথা। দিল্লীর মসনদে তখন মুঘল সম্রাট আকবর। তাঁর আমলের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন জনার্দন উপাধ্যায়। তখন তাঁর বাস ছিল উত্তরপ্রদেশে। সম্ভবত ব্যবসায়িক কারণে বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ও এসে উপস্থিত হন মেদিনীপুরের জীবনখালীতে, বর্তমানে যার নাম গেঁওখালী। সেইসময় মহিষাদল এলাকার জমিদার ছিলেন কল্যাণ রায়চৌধুরী। দুর্ভাগ্যবশত রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর জমিদারী নিলামে উঠল। জনার্দন উপাধ্যায় নিলামে কিনে নিলেন সেই জমিদারী এবং মহিষাদলে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। এই জনার্দন উপাধ্যায় হলেন মহিষাদল রাজপরিবারের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। এরপর এই রাজপরিবারের পঞ্চম বংশধর আনন্দলাল উপাধ্যায় সন্তানহীন অবস্থায় দেহত্যাগ করলে তাঁর স্ত্রী জানকীদেবী জমিদারীর ভার নিজের হাতে নেন। জানকীদেব এলাকার প্রভূত উন্নতিসাধন করেন ও বিখ্যাত গোপাল জিউ মন্দির তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর দৌহিত্র গুরুপ্রসাদ গর্গকে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। এভাবেই উপাধ্যায় পরিবার থেকে গর্গ পরিবারে জমিদারী হস্তান্তরিত হয়। এই বংশেরই জমিদার জ্যোতিপ্রসাদ গর্গ ও পরে সতীপ্রসাদ গর্গ ইংরেজদের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি পান।
বুকিং থাকলে তবেই চারচাকা ভেতরে ঢুকতে পারবে। বিশাল খোলা জায়গার মাঝে দাঁড়িয়ে ফুলবাগ প্রাসাদ। এই রাজবাড়ীর একতলায় তিনটি ঘর গেস্টদের জন্য বরাদ্দ – দুটি ডাবল বেডরুম ও একটি ৬ জন থাকার ঘর। গেস্টদের খাবারের ব্যবস্থা একটি বিশাল রাজকীয় ডাইনিংরুমে, আলাদা। একতলাতেই সংগ্রহশালা। দোতালায় রাজবাড়ীর বংশধরেরা এলে থাকেন। অনতিদূরে গোপালজিউ এর মন্দির!জুতো খুলে মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের প্রবেশের মুখে রয়েছে দুটি নহবৎখানা, যার ডানদিকেরটির নীচে একটা বিশালাকায় ধাতব ঘন্টা আছে। নবরত্নের আদলে তৈরী মন্দির অর্থাৎ ন’টি চূড়া বিশিষ্ট। মূল মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ। এছাড়াও দুটি শিবমন্দির, একটি জগন্নাথদেবের মন্দির ও একটি নাটমন্দির রয়েছে।
মহিষবাথান যেতে সময় লাগলো বাসে একঘণ্টা তারপর মহিষবাথান কলেজের ধার ঘেষে কিছু দূর হেটেই প্রকাণ্ড প্রাসাদ। সাদা রঙের প্রসাদের উপর সোনালী রঙের প্রলেপ কিছুটা ধুয়ে গেছে ঠীক তবে তাতে সৌন্দর্য্যের ঘাটতি কিছুই হয়নি । প্রসাদের ভিতরে রয়েছে অমূল্য সব নিদর্শন। যাঁরা “বসু পরিবার” তারা খুব রিলেট করবে প্রতিটি আসবাব আর ঘরের কোনার কোনার সাথে । কিছু দূরেই পুরনো রাজপ্রাসাদে অক্ষত দুটি সুন্দর সিংহ মূর্তি আর গোপালজিউ এর মন্দিরের তো তুলনা নেই।
তবে ভালোবাসার পানপাতা আঁকড় কেটেছে মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে । চতুর্দিকে যোগ দিয়ে লেখা অমুক যোগ তমুক । অজস্র সুন্দর ঝিল আর পুকুর ঘিরে বাহারি গাছ। সাম্প্রতিক আম্ফাণে ভেঙে পড়েছে পুরনো পাঁচিল আর প্রাচীন গাছ, তবুও প্রকাণ্ড মহীরুহের মতো শুয়ে পড়েও ওরা যেনো আরো সুন্দর। রাজকীয় ব্যপার বলে কথা। সংগ্রহশালা দেখে বোঝা যায় বর্তমান বংশধরেরা রক্ষনাবেক্ষনের বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস! বিলিতি আসবাব থেকে শুরু করে দেশী মাইক্রোওয়েভ, প্রাচীন ছবি, শিকারের ঘর, পুরনো পালকি কি নেই । ভিতরে ছবি তুলতে দেয় না তবে বাইরে লনে তুলতে বাধা নেই। সব টুকু ঘুরতে ঘন্টা তিনেক সময় লাগে!
পুরনো রাজবাড়ি (রঙ্গীবসান_প্যালেস):-
প্যালেসের সামনে সাম্রাজ্যের প্রতীক দু’টি পাথরের সিংহ থাকায় একে সিংহদুয়ার প্যালেসও বলা হয়। বর্তমানে এখানে ঢোকা যায় না, বাইরে থেকেই দেখতে হয়। এই বাড়ির আন্ডারগ্রাউণ্ডে ছিলো ঘোড়া রাখার জায়গা, গুমঘর। কথিত আছে, সেই আন্ডারগ্রাউন্ডে জলে পাহারাদার হিসেবে কুমীর ছাড়া থাকত। প্যালেসের আশেপাশে প্রচুর খালি জমি, পুকুর রয়েছে, আছে ভবানীর মাঠ। একসময় এই মাঠ ছিলো বিচার কার্য্যালয়, শূলে চড়ানোর জায়গা। অনতিদূরেই আছে পরিবারের প্রতিষ্ঠিত মদনগোপাল জিউ মন্দির। নবরত্নশৈলীতে তৈরি এই মন্দিরটি রাণী জানকী দেবী প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরে প্রবেশেপথের দু’ধারে আছে দু’টি নহবতখানা। মন্দির প্রাঙ্গণে আছে দুটি শিব মন্দির, একটি জগন্নাথ মন্দির ও নাটমন্দির। নাটমন্দিরে বিয়ের মণ্ডপ করা আছে। রথের দিন এখান থেকেই ঠাকুর রাজার পালকি চড়ে মহিষাদলের রথযাত্রায় সামিল হন। নিত্য পুজো ও ভোগ দেওয়া হয়। সাদা ভাত, ভাজাসহ পরমান্ন,পরমান্নই মূল প্রাসাদ।
নতুন রাজবাড়ী (ফুলবাগ_প্যালেস) পুরোনো রাজবাড়ীর কাছেই। রাজবাড়ীর সামনে লনে একটি কামান রাখা আছে। রাজবাড়ীর একতলাটি এখন সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। দোতলায় সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সংগ্রহশালা দেখতে হলে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে হয়। একতলার বারান্দায় রয়েছে কামান, পালকি। এছাড়া সংগ্রহশালায় দেখার জন্য রয়েছে:
১) দরবারকক্ষ – ঝাড় লন্ঠন,পাথরের টেবিল, গ্রামোফোন, তৈলচিত্র, সূর্যঘড়ি, বসার চেয়ার, আয়না ইত্যাদি,
২) শিকারকক্ষ - শিকার করা জন্তু জানোয়ারের সংরক্ষণ করা দেহ,
৩) অস্ত্রকক্ষ - নানাধরণের অস্ত্র, শিরোস্ত্রান, জুতো,
৪) বিনোদনকক্ষ - পিয়ানো, টাইপ রাইটার, বাদ্যযন্ত্র, বিলিয়ার্ড টেবিল,
৫) বিশ্রামকক্ষ - পুরনো সিড়ি ও রেলিং দেওয়া খাট, আয়না,
৬) পাঠকক্ষ - এটি এখন বন্ধ রাখা আছে।
রাজবাড়ীর পিছনে রয়েছে তিনতলা বাড়ি, যেখানে বাড়ির লোকেদের জন্য রান্না হতো।
এখন রাজবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, ভাড়া ৫০০০ থেকে ৮০০০ টাকা দিনপ্রতি। এখানে থাকলে পুরো রাজবাড়ি ঘুরে দেখা যায়।
প্যালেসের সামনে সাম্রাজ্যের প্রতীক দুটি পাথরের সিংহ থাকায় একে সিংহদুয়ার প্যালেসও বলা হয়।
সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা
মহিষাদল থেকে দূরত্ব প্রায় ৯ কি.মি.। রূপনারায়ণ নদীর ধারে গেঁওখালি। নদী এখানে খুব চওড়া। এখানে রয়েছে লঞ্চ ও নৌকার মেরামতি হয়। কাছেই রয়েছে তিন নদীর (রূপনারায়ণ, হলদি ও হুগলি নদী) সঙ্গমস্থল। নদীর পাড় থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার উপযোগী এই স্থান।
কি ভাবে যাবেন পথনির্দেশঃ
–> তমলুক থেকে টোটো পাওয়া যায় মহিষাদল রাজবাড়ি যাওয়ার জন্য।
–> পুরোনো রাজবাড়ি থেকে হেঁটে নতুন রাজবাড়িতে যাওয়া যায়।
–> মহিষাদল থেকে টোটো বা বাসে করে এখানে আসা যায়।
–> গাদিয়ারা থেকে লঞ্চে নদী পেরিয়েও আসা যায়।