বর্ধমান শহরের লুপ্ত এক জনজাতি ‘পাখমারা’
রাঢ় বাংলার মধ্যমণি এই বর্ধমান। বর্ধমান এক মিশ্র জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রবাহিত গঙ্গা দামোদর নদ নদীর অববাহিকায় পলি সঞ্চিত সমভূমির কৃষি অঞ্চল ও পশ্চিমাংশের কঙ্করাকীণ উচ্চ টিলা ভূমি। বনাঞ্চল অনুর্বর প্রস্তরময় গনডোয়ানাল্যান্ড’ খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ। কয়লা খনি কলকারখানা রেললাইন পাতা ইত্যাদি শ্রম ও বহুল কাজের শ্রমিক হিসাবে জেলার প্রান্তসীমায় অনেক অবাঙালি শ্রমিক এই জেলায় এসে বসবাস করছে। আবার স্বাধীনোত্তর ওপার বাংলা থেকে আগত ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পুনর্বাসন বসবাস করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে দুর্গাপুরের গোপালনগর, আসানসোলের মহিশিলা কলোনি, কাটোয়ার পাবনা কলোনি , কেতুগ্রামের শাখায় কলোনি কালনার যোগীপাড়া, লাট্টু বাবুর কলোনি, বর্ধমান শহরের শাকারি পুকুর , ইছালাবাদ, নীলপুর, ভাতসালা, বালিডাঙ্গা, বিধান পল্লী, উদয় পল্লী , রথ তলা ইত্যাদি এই সমস্ত এলাকার অধিবাসী গান স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে সাবেক পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আগত বলে বাঙাল নামে পরিচিত। তেমনি স্থানীয় অধিবাসীরা বাঙালদের কাছে ঘটি নামে পরিচিত।
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৬৫-৬৬ বছর পরে পারস্পরিক তীর্যক মন্তব্য ও বৈরিতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মিলন ঘনিষ্ঠতা ও বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হচ্ছেন বর্ধমানের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে উগ্র ক্ষত্রিয় বা আগুরি , মুসলমান , পাঞ্জাবি, ক্ষেত্রী বা ময়রা, গোপ, সদগোপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । আর জাতি-বর্ণ সামাজিক স্তর হিসাবে তেলি , ধোপা, বারুই, তন্তুবায়, গন্ধবণিক, সুবর্ণ, বণিক, কৈবর্ত প্রভৃতি ধর্মের দিক দিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান শিখ জৈন এবং হিন্দু ধর্মের নানা শাখা সমন্বিত পঞ্চপাসক এর অন্তর্গত। এছাড়াও জেলায় আছে বাউরী বাগদী মুচি নবশাখ সম্প্রদায় আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো শবর ,বীরহোর, কিরাত ,আহির প্রভৃতি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, জনজাতির কিছু লোক।
শেষোক্ত জনজাতি নিয়েই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। যারা আজ যান্ত্রিক সভ্যতা তথাকথিত প্রগতি বিশ্বায়ন ও গতিময়তার যুগে অবলুপ্তির পথে । অথচ এরাই একসময় জেলা ও শহরের উল্লেখযোগ্য জনজাতি ছিল । এরা প্রধানত নদনদী দিঘির ডাঙ্গা তীর বনাঞ্চলে বসবাস করত। এরা প্রধানত ছিল শিকার জীবনের ফুল ফল পাতা মধু সংগ্রাহক । এরা পশুপাখি শিকার করে মাংস বিক্রি করে ফল-ফলাদি মাংস ইত্যাদি ক্ষুন্নিবৃত্তি করত , জীবিকা নির্বাহ করতো। ডোম শবরদের সম্বন্ধে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ আছে ” নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোমারি কুড়ি আ” এবং “উচা উচা পাড়ত চাহি বসই সবরী বালী”। তথাকথিত শিক্ষিত সভ্য সমাজের বাইরে উচ্চ পার্বত্য বনাঞ্চলে শহরের বাইরে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে এরা বসবাস করত অরণ্য বৃক্ষ বন জঙ্গল যে তাদের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত তারা তাদের বিচরণ ক্ষেত্র স্থান থেকেই বোঝা যায় যেমন বিরহাটা, বনমসজিদ, বাদামতলা , রমনাবাগান, জিলিপি বাগান, বাবুরবাগ, মোহনবাগান, আমবাগান, তেঁতুল তলা, পলাশ ডাঙা, আমড়া, পলাশন, বনসুজাপুর, সিমডাল, বননবগ্ৰাম, প্রভৃতি।
বর্ধমান জেলায় বেশি অরণ্য নেই এককালে দুর্গাপুর ঘন অরণ্য আবৃত ছিল বনে ছিল শাল-পিয়ালে ,তাল-তমাল, মুরগা, মহুয়া, খেজুর, বৈঁচি, ডুমুর। আর বন্য প্রাণীদের মধ্যে ছিল বাঘ চিতাবাঘ হায়না, বন বিড়াল খরগোশ কাঠবিড়ালি না না বিষধর সাপ। আউসগ্রাম , গোপভূম, কাঁকসা দুর্গাপুর বনজঙ্গল অধ্যুষিত বনাঞ্চল জঙ্গলমহল নামে পরিচিত ছিল সেখানে থাকত আদিবাসী, বনবাসী শিকারজিবি সাঁওতাল ও পাখমারা সম্প্রদায়। ঝাড়ফুঁক তুকতাক মন্ত্র তন্ত্র ছাড়াও ব্যবহার করত বনাঞ্চল জাত, বনৌষধি ,অনন্ত মূল ,শতমূল কালো, মেঘ, বিশল্যকরণী, গুলঞ্চ ও বহেরা, বেল, হরিতকী, আমলকি, অর্জুন প্রভৃতি রোগ নিরাময় কারী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি। জীবিকা নির্বাহের জন্য পিঁপড়ের ডিম নানা ধরনের ছাতু , কুরকুরে ছাতু ,দুর্গা ছাতু , সাল ছাতু মধু শালপাতা কাঠ সংগ্রহ ও পশুপাখি শিকার করত এই জঙ্গলমহল ছোটনাগপুরের জঙ্গলের রোগ ছিল। বিহার ঝাড়খন্ড থেকে লোকজন এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতো বিশাল ও গভীর বনাঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে প্রবাহিত দা মুন্ডা দেবনাদ, দুঃখের দামোদর উত্তর-পশ্চিম থেকে প্রবাহিত হয়ে পুরো মুখে বীরভূমের ও বর্ধমানের সীমারেখা ছুঁয়ে অজেয় অজয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় সাঁওতাল পাখমারা, বুড়ো প্রভৃতি অজয় পেরিয়ে জঙ্গল মহলের মধ্যে দিয়ে বর্ধমানের ঢোকে। পাখমারা সম্প্রদায় হল একটি অরণ্যচারী শিকারি জিবি সম্প্রদায়। এরা আমাদের সামাজিক আচার আচরণ থেকে সবসময় যেন দূরে দূরে থাকতে চায়। এই রাঢ়বঙ্গের আসানসোল ,বানপুর ,দুর্গাপুর, বর্ধমান, আউসগ্রাম ,মেদিনীপুর ,বাঁকুড়া, পুরুলিয়া প্রতিষ্ঠান দেখা যায় ।এদের আদি নিবাস হাজারীবাগ অথবা জামুরিয়া বলে জানা যায় ।এরা সাধারণত জঙ্গলের কাছাকাছি জীবিকার স্বার্থে বসবাস করে । বর্ধমান শহরে এক সময় পাখমারা সম্প্রদায় ছিল। ছিল পশু পাখি শিকারের অনুকূল পরিবেশ- রমনার বাগান অঞ্চল, গোপালবাগের দিলখুশ উদ্যান অঞ্চল, কৃষ্ণসায়র, শ্যামসায়র, কমলাসায়র, রানিসায়র, চারদিকের পাড় ছিল সুউচ্চ নানাবিধ বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ । কাঞ্চন নগরের বিস্তৃত অরণ্য অঞ্চল বাদামতলা একাধিক কাঠবাদাম গাছ তেতুলতলা বকুলতলা মেহেদিবাগান জি টি রোডের দুধারে অশ্বথ গাছের সারি ছোটনিল্পুর বড়নীলপুর ইচ্লাবাদ টাউন স্কুলের তৎকালীন নীলকুঠির বাগান, বাকার তীরে আম কালোজাম বেল, গাব, খিন্নি, বৈঁচি বাতাপিলেবু কামরাঙ্গা সফেদাবাদ ইছালাবাদ, চাঁদমারি মাঠ ও পুলিশ লাইন এর কাছে ফলের বাগান ছিল। পুলিশ লাইনের পূর্বে জিটি রোডে গায় চকদিঘী সিংহ রায়দের বাগান হরিবংশ পরিবারের কৃষি খামার বর্ধমান রেল স্টেশনের সামনে ছিল নিম গাছ। রূপ মহল সিনেমার পাশে ছিল এক বটগাছ। পুলিশ লাইন ও কানাই নাচ শালা ঘরদোর চটি প্রবেশ মুখে জিটি রোডে দুই ধারে ছিল বট জাম দেবদারু ও ঝাউ গাছ। এছাড়া রেললাইন ও দামোদরের তীরে ছিল অনেক বনাঞ্চল । পাখমারা রাস্তার দুই ধারে গাছে দড়ি বেঁধে বাদুড় চামচিকে তিতির প্রভৃতি ধরার জন্য তাদের উড়ে যাবার গতিপথের জাল টাঙিয়ে রাখত। গাছে বসার আগে তারা আটকা পড়ে যেত ।আবার গাদা বন্দুক ও সবুজ পাতার ডাল নিয়েও তারা বাঁকা দামোদর তীরবর্তী অঞ্চলে বনমুরগী ইত্যাদি স্বীকার করতে যেত। কখনো দেখা যেত কঞ্চির মতো ফাপা বাঁশে আঠালো পদার্থ লাগিয়ে এক এক করে সুর কঞ্চির মতো বাস জুড়ে লম্বা আকশি নিয়ে শিকারের ডানায় আঠা লাগিয়ে ধরত। আবার কখনো বর্ষি জাতীয় ফলাও ব্যবহার করত। তন্দ্রাচ্ছন্ন পাখির পেটে তীক্ষ্ণ ফলা মুখ ঢুকিয়ে দিতো গাছের তলায় পাখির মত মাটি পরীক্ষা করে বুঝতে পারত গাছে চামচিকা পাখি আছে কিনা ।
আজ থেকে 50 বছর আগে বর্তমানে পথে-ঘাটে বনাঞ্চলে পাখমারা দের পাখি শিকার করতে দেখা যেত । আমি আমার কৈশোরে আমাদের বাড়ির রাস্তার ধারে গাছ থেকে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে পাখি ধরতে দেখেছি ।বর্ধমান শহরে পাকমারা থাকতো সিএমএস স্কুলের পিছনে ।তাদের নিবাস ফলের নামে হয়েছিল পাকমারা গলি বা লেন। পাকমারা কথাটি এসেছে পাখিমারা থেকে। এখন আর শিকারি ছবি পাখমারাদের দেখা যায় না ।তাদের দীর্ঘদিনের নিবাস স্থলের পরিবর্তন হয়েছে নগরায়নের চাপে তাদের নামাঙ্কিত গলি দুটির ঘটেছে নামান্তর। পৌরসভার খাতায় আজ এক নম্বর পাকমারা লেন হয়েছে বর্ধমান রাজের জনৈক পত্তন ইদার দেবেন্দ্রনাথ মিত্রের নামে ডি এন মিত্র লেন এবং দু’নম্বর পাকমারা লেন এর নাম হয়েছে অমূল্যচরণ মিত্রের নামে এ সি মিত্র লেন। সভ্যতার নাগরিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত অরণ্য প্রকৃতির সন্তানেরা উদ্বাস্তু হয়ে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বাস্তব কারণে জীবনযাপনের স্বার্থে এদের বংশধররা ঘটিয়েছে পেশার পরিবর্তন। জনসংখ্যাবৃদ্ধি জনিত কারণে বন-জঙ্গল ধ্বংসের ফলে শিকার ও অরণ্য সম্পদ প্রাপ্তির অনিশ্চিয়তায় পূর্বপুরুষের ত্যাগ করে এরা যেতে বাধ্য হয়েছে। লোক সংস্কৃতি ও ইতিহাস রাজা রাজার ইতিহাস নয় মানুষের ইতিহাস। এখন বর্ধমান শহরে পাক বলেন অতীতের স্মৃতি বাহিত এক লুপ্ত জনজাতির প্রতিনিধি পাখিমারা শিকারি জিবি জাতির কথা নৃতাত্ত্বিক গবেষক ও কৌতুহলী পাঠকদের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।