সাহেবজাদী জোহরা সেহগাল ছিলেন অসাধারণ নিত্য শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান ‘তোমার নৃত্য অমিত বৃত্ত ভরুক চিত্ত মম’ এই গানের মূর্ত প্রতীক ছিলেন জোহরা। উদয় শংকরের দলে জোহরা, সিমকি, অমলাশঙ্কর উদয়শঙ্করের নৃত্যের ধ্রুপদী আঙ্গিকের বিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন হাস্যে লাস্যে ও অভিনয় কলায় অভিনয় কলায় জোহরা উদয়শংকরের দলে একজন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতেন । তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ তথা আই পি টি এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং অসাধারণ চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসাবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।
সম্প্রতি জোহরা সেহগাল ১০২ বছর জীবন যাপন করে প্রয়াত হয়েছেন (১৯১২-২০১৪)
তিনি রাজিলা পাঠান সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। আগে তাঁরা দেরাদুনের কাছে চাকার্টায় থাকতেন।
পারে তারা শাহরানপুরেই বাড়ি তৈরি করে থাকেন। তাঁর বাবা ও মা ছিলেন মমতাহউল্লা খান এবং নটিকা বেগম। তাদের সাতটি সন্তান ছিলদুই ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। জোাহরা সেহগল ছিলেন তৃতীয় সম্ভান। তার নাম রাখা হয় সাহেবজাদী জোহরা বেগম। যখন জোহরার এক বছরের কিছু বেশি বয়স, তখন তাঁর চোখে পলুকমা
ধরা পড়ল। চোখের চিকিৎসার জন্য জহুরাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বার্মিংহামের এক চোখের হাসপাতালে চিকিৎসা
হয়। কিন্তু তিনি একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি ছেলেবেলায় একটু টমবয় স্বভাবের ছিলেন। তিনি তখন অনায়াসে গাছে উঠতেন, যা সাধারণত সম্ত্রান্ত ঘরের মেয়েরা তখনকার দিনে করতেন না। জোহরা খুব অল্প বয়সে তার মাকে হারান। মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে ও তার বােন উহরাকে লাহােরের কুইন মেরি কলেজে ভর্তি করা হয়। তখনকার দিনের প্রথা অনুযায়ী কুইন মেরি কলেজেও কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলা হতাে। যদি কোনাে পূরুষ বক্তা কলেজের সেমিনারে আসতেন, তাঁদের চিকের সামনে বক্তৃতা করতে হতাে। চিকের আড়ালে এসে মেয়েরা তাদের কথা শুনতেন।
দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বতী সময়ে তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন।তখন উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম,
সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম বাড়ছে। কুইন মেরি কলেজের ছাত্রী জোহরার স্বপ্ন ছিল তিনি অভিনেত্রী হবেন। তাই তিনি স্নাতক হবার পর ইউরােপে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর এক মামা সাহেবজাদা শহিদুজ্জাফর তখন তাঁকে মােটর গাড়িতে করে ইরান, ইরাক, প্যালেস্টাইন, দামাস্কাস হয়ে আলেজান্দ্রিয়া বন্দরে জাহাজে
তুলে দেন। তিনি গ্রেট ব্রিটেনে একজন অভিনেতার কাছে নাট্যচর্চার বিভিন্ন আঙ্গিক শিক্ষা করতে লাগলেন।
পরে তিনি শিক্ষাকে আরও সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ করার জন্য ড্রেসডেনে মেরি উইগম্যানের ব্যালেস্কুলে ভর্তি হলেন। তিনি নীলনয়না ছিলেন। একদিন উদয়শংকর ট্রপের নাচ দেখে তিনি মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে যান। তিনি সােজা
গ্রিনরুমে গিয়ে উদয়শংকরের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর ট্রুপে ড্রেসডেনে
যােগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। উদয়শংকর বলেন যে জোহরা
তাঁর শিক্ষা আগে সম্পূর্ণ করুন, পরে তিনি ভারতে ফিরে গিয়ে
উদয়শংকরের দলে যােগ দেবেন। কিন্তু হঠাৎ উদয়শংকর জোহরাকে তাঁর সঙ্গে জাপানে যাওয়ার জন্য টেলিগ্রাম করলেন। জোহরা জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজিপ্ট এবং ইউরােপের বিভিন্ন দেশে
উদয়শংকরের দলের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করলেন। ১৯৪০ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং আলমােড়ায় উদয়শংকরের সংস্কৃতি কেন্দ্রে যােগ দেন। তাঁর ভাবী স্বামী কামেশ্বর সােহগালের
সঙ্গে তাঁর আলমােড়াতেই প্রথম পরিচয়। কামেশ্বর তাঁর তুমনায় ৮ বছরের ছােটো ছিলেন। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ও নৃত্যশিল্পী ছিলেন। চিত্রাঙ্কনেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। কামেশ্বর রাধাস্বামী সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। তিনি জোহরাকে দেবীজ্ঞানে পুজোকরতেন। পরবর্তীকালে তা প্রেমে রূপান্তরিত হয়। আত্মীয়স্বজনের তীব্র বিরােধিতা সত্ত্বেও তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৩ সালে এই দম্পতি লাহােরে জোহয়েশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খােলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল নৃত্য, গীত, অভিনয় ইত্যাদি চর্চা করা। ইতিমধ্যেই তার ছােটো বােন উহরা মুম্বই চলে যান এবং সেখানে পৃথী থিয়েটারের শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৫ সালে প্রধানত উহরার আগ্রহে জোহরা ও কামেশ্বর মুম্বই চলে যান। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি তখন লাহােরের পরিবেশ উত্তরােত্তর বিষাক্ত করে তুলেছিল। জোহরা ও উহরার অভিভাবকদের সম্মতি না থাকলে
তারা কখনােই সংস্কৃতি জগতের এত উঁচুতে উঠতে পারতেন না।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য জোহরার এক দিদি হাজরা বেগমের সঙ্গে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জেড, এ. আমেদের বিয়ে হয়। হাজরা বেগম ছিলেন উর্দু খাড়িবােলি সাহিত্যের একজন লেখিকা। ১৯৪৫
সালে মুম্বইতে এসেই জোহরা পৃথ্বী থিয়েটারে যােগ দেন। পৃথ্বী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর, যিনি রাজ কাপুরের পিতা ছিলেন। পরবর্তী ১৪ বছর জোহরা মুম্বইতে কাটিয়েছেন।
মাসিক চারশাে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। পাকিস্তান গঠিত হলে উহরা ও তার স্বামী হামিদ বাট পাকিস্তানে চলে যান।
মুম্বইতে আসার পরেই তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যােগ দেন। এই সময় প্রধানত পি সি যােশীর উদ্যোগে ভারতে প্রগতি। লেখক সংঘ এবং গণনাট্য সংঘ গড়ে ওঠে। প্রগতি লেখক সংঘ । এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘে তখনকার দিনে দিকপাল লেখক,
অভিনেতা ও চিত্রশিল্পীরা যােগ দিয়েছিলেন। তারা নাৎসিবাদের। বিরােধী ছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার সংস্কৃতিতে তারা। বিশ্বাস করতেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র,।
পণ্ডিত রবিশংকর, ঋত্বিক ঘটক, ফয়েজ আমেদ ফয়েজ, শাহির লুধিয়ানভি জোস মালিহাবাদী, মগদুম মহিউদ্দিন প্রমুখ গণনা
সংঘের সদস্য ও পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। আই.পি.টি.এ.-র উদ্যোগে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যে দুটি ছবিতে জোহরা অভিনয় করেন। একটি ছবি হল ‘ধরতি কে লাল। এই ছবির কাহিনীকার ছিলেন কিষেণ
চন্দর। তাঁর ‘অন্নদাতা’ গল্পটিকে ভিত্তি করে ‘ধরতি কে লাল’ ছবিটি তৈরি হয়েছিল। মুনাফাখােরদের লােভের ফলে কীভাবে ৩৫ লক্ষ লােক গ্রাম থেকে শহর কলকাতায় এসে একটু ফ্যান দাও, একটু ফ্যান দাও’ বলে চিৎকার করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে—এই ছিল অবিভক্ত বাংলার মহামন্বন্তরের ছবি। এই কাহিনিটিকে নাট্যরূপ দেন কে এম আব্বাস এবং বিজন ভট্টাচার্য।
শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র এই ছবিতে অভিনয় করেন এবং সুরারােপ করেন রবিশংকর। ইউরােপের কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবি প্রশংসিত হয়।
জোহরার দ্বিতীয় ছবি ‘নীচা সংসার’ গাের্কির লােয়ার ডেপথস’-এর অনুকরণে লেখা হয়েছিল। খাজা আমোদ আবাস
কাহিনিটি রচনা করেন এবং চেতন আনন্দ ছবিটি পরিচালনা করেন।
১৯৫৯ সালে তাঁর স্বামী ও সহমর্মী কামেশ্বরের মৃত্যু হয়। তিনি এরপর কিছুদিনের জন্য দিল্লি আসেন এবং সঙ্গতি নাটক অ্যাকাডেমির ফেলাে নির্বাচিত হন। তারপর একটা স্কলারশিপ পেয়েতিনি ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ড যান। ১৯৮২ সালে জোহরা মন্টে আইভরি প্রােডাকশনের ‘দ্য কোর্টেজাত্স অব বােম্বে’ ছবিতে অভিনয় করে তুমুল সুখ্যাতি অর্জন করেন। তারপর তিনি জুয়েলস ইন দ্য ক্রাউন’, ‘তন্দুরি নাইটস’, ‘মাই বিউটিফুল লনড্রেট ইত্যাদি
অইভনয় করে খ্যাতির মধ্যগগনে ওঠেন।
বিগত শতাব্দীর নবম দশকে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন, যখন তার আশি বছরের ওপর বয়স হয়ে গেছে। তখন
তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে উদয়শংকরের স্মৃতি অনুষ্ঠানগুলিতে
যােগ দিতেন। কনিষ্ঠ বােন উহরার সঙ্গে ‘এক থি নানিতে’ তিনি অভিনয় করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এই নাটকটি ইংরেজি উর্দু-দুই ভাষাতেই রচিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।
বম্বেতে তিনি রাজ কাপুরের সঙ্গে বাজনার তালে তালে নৃত্য
পরিবেশন করেছিলেন রাজপথে। অমিতাভ বচ্চন বা ঐশ্বর্য রাই তাকে ‘চিনি কম’ বা ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এ স্নান করতে পারেননি। তিনি অভিনয় ভালােবাসতেন এবং জীবনের শেষ দিকে
বিভিন্ন ছবিতে আহ্লাদী দাদিমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেছে। তিনি কালিদাস সম্মান পেয়েছিলেন। সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলাে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সহমতের
উদ্যোগে দিল্লি লালকেল্লার সামনে তিনি সিপাহী বিদ্রোহের একশাে পঁচাত্তরতম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আবাসনের নিচের তলায় একটা ফ্ল্যাট চেয়েও তিনি পাননি, যখন
তার হাঁটুর নিচে মারণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়েছে। আমলাতন্ত্রের কারসাজিতে এইরকম একটা নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
তিনি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, শাহির লুধিয়ানভি, মগদুম মহিউদ্দীনের দীর্ঘ কবিতা অক্লেশে স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে
শ্রোতাদের বিস্ময় উৎপাদন করতেন।
লােদী রােডে অবস্থিত শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
অন্ত্যেষ্টির সময় তাঁর পুত্র অশােক, কন্যা করুণা এবং অন্যান্য নাতি নাতনিরা শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী, শীলা দীক্ষিত, জাভেদ আখতার, শাবানা আজমি, নাট্যব্যক্তিত্ব, এম. কে. রায়না, প্রসার ভারতীর ডিরেক্টর জহর সরকার শেষকৃত্যে উপস্থিত
হয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তথ্যসূত্র
১. সােহেল হাশমি, ‘ফ্রন্টলাইন’, ৮ অগস্ট, ২০১৪, পৃ. ১০৭-১১০
২. রত্নোত্তম সেনগুপ্তা, ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’, অগস্ট ৬, ২০১৪, পৃ. ৫
৩. প্রভাংশুবিকাশ সাহা, ‘আজকাল’, ৭ অগস্ট, ২০১৪, পৃ. ৪
৪, ‘পিপলস ডেমােক্রেসি’, জুলাই ১৪-২০, পৃ. ১১
৫. ‘সাপ্তাহির বর্তমান’, ২ আগস্ট, ২০১৪, পৃ. ৬২