স্যার গেরি
হ্যাঁ এই নামেই তার জীবনী লিখেছিলেন ট্রেভর বেইলি। যদিও তার গালভরা পুরো নাম গারফিল্ড সেন্ট অব্রান সোবার্স- নিঃসন্দেহে আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটার রেকর্ডবুক দিয়ে ক্রিকেটারদের গুণ বিচার করা যায় না অবশ্য তার টেস্ট রেকর্ড অসাধারণ 93 টেস্টে টেস্টে 8,032 রান (বয়কট এর আগে বিশ্ব রেকর্ড) গড় প্রায় 58 ( যেকোনো গ্রেট ব্যাটসম্যানের তুলনায় ভালো) সর্বোচ্চ রান 365 নট আউট 37 বছর স্থায়ী বিশ্বরেকর্ড 26 টি সেঞ্চুরি , 50টি অর্ধশতরান 235 উইকেট 35 এবং 109টি ক্যাচ।
চোখধাঁধানো রেকর্ড কিন্তু রেকর্ড বুকের দিকে তাকিয়ে খেলেননি কখনো। অকাতরে উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন অনেক সময়, নইলে থামতে কোথায় কে জানে। জীবনের শেষ ভাগে একটিমাত্র ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। টি-টোয়েন্টি তো ভাবাই যায় না অথচ সীমিত ওভারের খেলায় ছিল তার সবচেয়ে উপযুক্ত।
উইজডেন ক্রিকইনফো রাশি বিজ্ঞানের মতে টেস্টে ব্যাটিং গড় আর বোলিংয়ে নিরিখে জাক কালিস ছাড়া তার ধারে কাছে কেউ আসে না। মনে রাখতে হবে ডন ব্র্যাডম্যানের উক্তি তিনি একাই ছিলেন 4 জন প্লেয়ার। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বাঁহাতি স্পিনার ও বোলার এবং অসাধারণ ফিল্ডার বিশেষজ্ঞরা বলছেন তিনি দু’ধরনের স্পিন বোলিং করতেন- মামুলি ফিঙ্গার স্পিনার এবং
চায়নাম্যান বোলিং করার রিসট স্পিনার সুতরাং একে তার নয় পাঁচ ( ফাইভ ইন ওয়ান) ই বলা উচিত।
মানুষ সোবার্স সম্বন্ধে আমরা জানি কম। তার জন্ম বার্বাডোস দ্বীপের ব্রিজটাউন এর বেলান্ড অঞ্চলে। এই ছোট্ট শহর ব্রিজটাউন থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বহু তারকা প্লেয়ার বেরিয়েছেন । কিন্তু নিঃসন্দেহে তাদের সবার সেরা সোবার্স।
আজ থেকে 82 বছর আগে হাজার 936 সালের 28 শে জুন তার জন্ম বাবা শামন্ট জাহাজে কাজ করতেন । তাই তাদের অবস্থা ভালোই ছিল তার ছয় বছর বয়সে জার্মান টর্নেডো আক্রমণে জাহাজডুবিতে বাবার মৃত্যু হলে মা থেলমা 6 টি ছেলে-মেয়ে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন। বড় ছেলে জর্জকে হাই স্কুল ছেড়ে কাজের উঠতে হয় । গেরি আর তার পিঠেপিঠি দাদা জেরি হাই স্কুলে যেতে পারেনি। পাড়ার স্কুলের পাঠ শেষ করতে হয় অবশ্য সত্যি কথা বলতে কি পড়াশোনায় তাদের তেমন মন ছিলোনা মাঠে-ঘাটে সমুদ্রের ধারে রাস্তায় সর্বত্র ক্রিকেট ফুটবল বাস্কেটবল খেলে বেড়াতেন। সারা ব্রিজটাউন এই সোবার্স ভাইদের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে মাত্র 15 বছর বয়সে বার্বাডোস এর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন উইলফ্রেড ফার্মেরের নজরে পড়ে পুলিশ ব্যান্ডে ঢুকে পড়েন। সে বছরেই লিগ ক্রিকেট বিখ্যাত ওয়ান্ডারাস দলের হয়ে সফরকারী ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে খেলেন। 9 নম্বর ব্যাট করেছিলেন বটে কিন্তু তার বাঁ হাতি স্পিন বোলিং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 89 ওভারে 142 রানে 7 উইকেট ।
এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিছুটা আকস্মিকভাবে পরের মরসুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টে নির্বাচিত হন । ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারলেও 9 নম্বরে ব্যাট করেন সোবার্স। তার বাঁ হাতি স্পিন বোলিং এর উইকেট তুলে নেন চারটি। এরপরের মরশুমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চারটি টেস্ট খেলে । শক্তি শালী অস্ট্রেলিয়ার কাছে সহজেই হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু সোবার্স সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এবার ছয় নম্বর ব্যাটিং শুরু করলেও চতুর্থ টেস্টের স্টলমেয়ার আহত হবার পর সরাসরি ব্যাটিং ওপেন করেই কিথ মিলনকে প্রথম তিন বলে 3 টে বলে 4 মেরে শুরু করেন। শেষ অব্দি 10টা চার মেরে 43। আবার শেষ টেস্টে অর্ধশত রান কয়েকটি উইকেট পান। নিউজিল্যান্ড সফরে সাফল্য না পেলেও পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরে তার স্থান পাকা হয়ে যায় এই 1957 সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্রী এবং তাদের ব্যাটিং মুখ থুবড়ে পড়ে।
সোবার্স কিন্তু দুবার অর্ধশত রান করেন টেস্ট সিরিজে এবং শেষ টেস্টে ও ভালো যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ 89 আর 86 রানে চূর্ণ হয়ে যায় তখনও সোবার্সের ( তিন নম্বরে) দুই ইনিংসেই সর্বোচ্চ রান 39 আর 42। গোটা সফরে তিনি দারুণ সফল তিনটে সেঞ্চুরিসহ ইংল্যান্ড ঠান্ডা ভেজা আবহাওয়া বেস্ট ইন্ডিয়ানরা কখনোই পছন্দ করতেন না। কিন্তু সোবার্স ইংল্যান্ডে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল 1958 থেকে 1975 পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ঘরবাড়ি ছিল চারটে সফর (1963,1966, 1969, 1973) ছাড়াও সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে নোটন (1968-75) খেলেন এবং সব রকম সম্মান এনে দেন নিজের দলকে। আবার ইংল্যান্ডে তার সবচেয়ে দুঃখের দিন আসে 1959 সালে। যখন খেলার পর গাড়ি চালিয়ে ফিরতে গিয়ে গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয় তিনি ফাস্ট বোলার টম ডিউডানি আর তার প্রিয়তম বন্ধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা অলরাউন্ডার কলি স্মিথ ছিলেন সেই গাড়িতে। সোবার্স আর ডিউডানি আঘাত থেকে সেরে উঠলেও স্মিথের কাল ঘুম আর ভাঙ্গেনি। এই লোক গেরিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন মদ খেতেন বেশি তবে শেষ পর্যন্ত নিজেই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠে ক্রিকেটে ফিরে আসেন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে সোবার্স আর স্মিথ দুজনের হয়ে তাকে খেলতে হবে ইতিমধ্যে 21 বছর বয়সে তিনি বিশ্বসেরাদের একজন হয়ে দাঁড়ান পাকিস্তানের প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। প্রথম টেস্ট ভালোভাবে ব্যাট করেন। কিন্তু কিংস্টনে তৃতীয় টেস্টে যা করলেন তা যেন রূপকথার গল্প। হাটনের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে মাত্র 21বছর 216 দিন বয়সে করেন 365 নট আউট আজও তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান। এ রেকর্ড গড়তে হাটনের থেকে তিন ঘন্টা কম ব্যাট করেন। আবার কনরাড হাটনের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে 446 রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন। রেকর্ডের খেয়াল তার থাকতো না। তিনশোর দোরগোড়ায় ক্লাইভ ওয়ালকট তাকে মনে করিয়ে দেন সে কথা । এটি তার প্রথম সেঞ্চুরি ও একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি। আবার পরের টেস্টে করেন দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি, পরপর ছয়টি ইনিংসে অর্ধশত রান পার করে সিরিজে 828 রান করেন। তখন তিনি নিঃসন্দেহে বিশ্বসেরা এরপরেই ভারত সফর (1958-59) তিনটে টেস্ট সেঞ্চুরি করেন, পাকিস্তানে সফর হননি তেমন। কিন্তু ইংল্যান্ডে বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে (1959-60) আবার তিনটে টেস্ট সেঞ্চুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে থ্রি ডব্লু র যুগ শেষ হয়ে তখন সোবার্স যুগ। 1959-60 সিরিজের প্রথম টেস্টে তিনি (226) আর ওরাল (197 নোট আউট) টানা দু দিন ব্যাট করে দলকে বাঁচান।
এ পর্যন্ত খেলেছেন শ্বেত্বাঙ্গ ক্যাপ্টেনের অধীনে গডাড, স্টলমেয়ার ডেনিস অ্যাটকিনসন , আলেকজান্ডার এবং তাতে অসুবিধার কথা খোলাখুলি বলেছেন । এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত 1960-61 বর্ষ বেশ অস্ট্রেলিয়া সফরে ওরেলকে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। সেই সিরিজটীও ছিল ঐতিহাসিক। প্রথম টেস্ট ম্যাচে টাই এবং সিরিজটি 2-1 ম্যাচে হেরে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সকলের হৃদয় জয় করে। এই ওয়েস্টইন্ডিজের স্বর্ণযুগের শুরু। অস্ট্রেলিয়াতে সোবার্স দুটি সেঞ্চুরিসহ 430 রান করেন (ব্রিসবেনের টাইটেস্ট 132) 15 টি উইকেট (মেলবোর্ন শেষ টেস্টে একটানা 41 ওভার, 8 বলে বল করে 5 উইকেট ) আর 12 টি ক্যাচ। রাজকীয় মেজাজে খেলেছিলেন পরের মরসুমে দুর্বল ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে দুটি সেঞ্চুরিসহ 428 রান, বল হাতে 23 উইকেট। তখনই তিনি নিয়মিত জোরে বল আরম্ভ করেন এবং বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের স্বীকৃতি পান ।
এরপরে ওরেল অবসর নিলে অধিনায়ক নির্বাচিত হন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। ক্যাপ্টেন হিসাবে শুরু করেছিলেন খুব ভালোভাবে। ববি সিম্পসনের অস্ট্রেলিয়া দলকে হারানো 2-1 ম্যাচে যদিও তিনি নিজে তেমন সাফল্য পাননি। 1966 ইংল্যান্ড সফর তার সেরা। 3-1 ম্যাচে জয়, 3সেঞ্চুরি সমেত 772 রান 20 উইকেট 10 ক্যাচ।
অলরাউন্ডার হিসাবে বিশ্বসেরা তারপরেই ভারত সফরে 2-0 জয়। 3টি টেস্টে 5টি ইনিংসে অর্ধশত রান, 14 উইকেট। কিন্তু চাকাটা ঘুরে যাই তারপরে। 1967-68 মরশুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেরিতে ডিক্লেয়ার করার জন্য একটা টেস্ট ড্র করে চতুর্থ টেস্টের ডিক্লেয়ার করে 92-2তে ইংল্যান্ড কে 165 মিনিটে 215 রানের টার্গেট দিয়ে। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে বয়কট আর কাউড্রের মতন ব্যাটসম্যানরা মারকাটারি ব্যাট করে তাদের জিতিয়ে দেয় । ঘুমপাড়ানি টেস্ট সিরিজে এই পরাজয়ের পর দশক থেকে নির্বাচক সকলের কাছে ব্রাত্য হয়ে দাঁড়ান সোবার্স। শুধু এই সিরিজে নয়, পর পর তারা টেস্ট সিরিজ হারেন অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড ও ভারতের কাছে। এমনকি নিউজিল্যান্ড সঙ্গে দুটো সিরিজ ড্র করে।
সোবার্সের চোট আঘাতজনিত সত্বেও তার ব্যক্তিগত কিন্তু খারাপ ছিল না 8 টি সেঞ্চুরি আর 71 টি টেস্ট উইকেট আসে এই সময়ে । তবে তার মনে হয়েছিল যে খেলা থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ালেন অধিনায়কত্ব ছেড়ে। তার প্রিয় বন্ধু রোহান কানহাইকে ক্যাপ্টেন করা হয়।
এই কঠিন সময়েও সোবার্স দিন এসেছিল একবার। 1968 সাল, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের শেষদিকে সোবার্স নটিংহ্যামশায়ার খেলছে গ্লামারগান দলের বিরুদ্ধে সোয়ানসির সেন্ট হেলেনা মাঠে। তারিখটা 31 আগস্ট। ডিক্লেয়ার করার জন্য দ্রুত রানের খোঁজে ছিলেন সোবার্স। বল করছিলেন 23 বছর বয়সী ম্যালকম ন্যাশ। ওভারের প্রথম চারটি বলেই সোবার্স অক্লেশে ছক্কা মারলে দুটো মাঠের বাইরে, পঞ্চম বলটা গেল বাউন্ডারি ধারে রজার ডেভিসের হাতে । তিনি হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলেন বাউন্ডারি দড়ির ওপর। আবার ছয়। শেষ বলটা করার সময় ন্যাশ বাঁহাতি স্পিন ছেড়ে মিডিয়াম পেস বল করলেন। সেটা উড়ে গেল মাঠ, প্যাভিলিয়ন, রাস্তা পেরিয়ে। পরেরদিন বলটা খুঁজে পাওয়া গেলে তা বাঁধিয়ে উপহার দেওয়া হয় সোবার্সকে। আজও তা ট্রেন্ট ব্রিজ প্যাভিলিয়নের শোভা পাচ্ছে । এক ওভারে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ছয় ছক্কার ঘটনা এই প্রথম। 16 বছর পরে রবি শাস্ত্রীয় তা করেছিলেন। সোবার্স আত্মজীবনীতে লিখেছেন এ ঘটনা তিনি ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেননি ন্যাশও। সেই ওভারটি স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
অধিনায়কত্ব ছেড়েও সোবার্স বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সুখে ছিলনা। 1972-73 সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার কাছে 2-0 হারলো তার দল।সোবার্স কিন্তু নির্বাচিত হননি সম্ভবত মুখ্য নির্বাচক ওয়ালকটের সঙ্গে তার মতানৈক্যের জন্য। ফিরে এলেন 1973 সালের ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টে দুর্ধর্ষ অপরাজিত 150 রান করলেন। তার দল টেস্ট সিরিজ জিতলো। এই তার শেষ টেস্ট সেঞ্চুরি। 1973-74 সিরিজ ইংল্যান্ডের সাথে অমীমাংসিত হলেও সোবার্সের সবোর্চ্চ রান ছিল 50। চোট আঘাতের সমস্যা কাটিয়ে উঠে ইংল্যান্ড কাউন্টি খেলেছেন চুটিয়ে 1974 সালে। কিন্তু সেই শেষ! ভাবতে অবাক লাগে আরেকটি বছর যদি তিনি খেলতেন ভারতে আসতে পারতেন 1974-75 মরশুমে, এমনকি 1975 বিশ্বকাপেও ফেলা সম্ভব ছিল। নির্বাচকরা কি এটুকু তাকে এবং আমাদের দিতে পারতেন না?
খেলোয়াড় জীবনের প্রায় শেষ দিকে একটি ঘটনা ঘটে যা আমরা সচরাচর খেয়ালই করি না। বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকা এ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেট খেলত শুধু ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সোবার্স তাদের কোন প্লেয়ারের খেলা দেখেননি। শেষ পর্যন্ত 1969 এর শেষে বর্ণবিদ্বেষের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ক্রিকেট থেকে বহিস্কৃত হয়। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া সফর বাতিল হওয়ায় তাদের ক্ষতি সামলাতে সারা পৃথিবী থেকে নির্বাচিত বাছাই প্লেয়ারদের দিয়ে ‘অবশিষ্ট বিশ্ব দল’ গঠন করে দুটি দেশ সফরের এর ব্যবস্থা করা হয়। অবশিষ্ট দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন সোবার্স। ইংল্যান্ড সফরে তার সঙ্গী হোন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কানহাই, লয়েড, ডেরিক মারে আর গিবস, ভারতের এঞ্জিনিয়ার আর বেদী পাকিস্তানের ইন্তেখাব ও মুস্তাক মুহাম্মদ অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকেঞ্জি আর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ব্যারি রিচার্ডস, গ্ৰেম পোলক, মাইক প্রোক্টার আর এডি বালো।
এই প্রবল শক্তিশালী দলের কাছে ইংল্যান্ড দাঁড়াতে পারেনি 4-1 ম্যাচে হারে। 34 বছর বয়সী সোবার্স রান করেন 588 দুটি সেঞ্চুরি ,21 উইকেট। 1971-72 মরশুমে কিন্তু অবশিষ্ট দল এত শক্তিশালী ছিল না। আর অস্ট্রেলিয়ার আগুনে ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি কে সোবার্স সেই প্রথম দেখলেন। পার্থ টেস্টের আগুন ঝরানো উইকেটে লিলি 8-29 নিয়ে তাদের হারিয়ে দেন। পরের ম্যাচে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে ওদের ক্যাপ্টেন ইয়ার চ্যাপেল কে বলেন, ‘শুনলাম তোমাদের লিলি নাকি জোরে বল করেন। যখনই আমি নামি ও আমাকে বাউন্সার দেয়। ওকে বলে দিও আমিও জোরে বল করতে পারি আর ওর থেকে একটু ভালো ব্যাট করি আমাকে যেন সমঝে খেলে।’ কথা গুলো সবই নিলি শুনতে পাচ্ছিলো পষ্ট । প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে লিলির বলে বিদায় নেন সোবার্স।
লিলি যখন ব্যাট করতে আসেন তাকে যে বাউন্সার দেন সোবার্স তা লিলি দেখতে পাননি। শেষমেষ তিনিও শূন্য রানে আউট হন সোবার্স বলে। প্রথম ইনিংসে 101 রানে পিছিয়ে থাকে অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ। দ্বিতীয় ইনিংসে লিলি আর ম্যাসির বিরুদ্ধে তখন সোবার্স নামেন তখন তার দলের 146-3। লিলির হিংস্র আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়িয়ে সোবার্স মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বল পাঠিয়ে দেন অক্লেশে। দ্বিতীয় নতুন বলে লিলি তিন ওভারে একাই 29 রান করেন শেষ পর্যন্ত থামেন 258 রানে, 35 টি চার, আর 2টি ছয় সমেত তখন তার বয়স প্রায় 36। যারা সে ইনিংস দেখেছেন তারা আর ভুলতে পারেননি। ব্র্যাডম্যানের মতে 50 বছরে তার দেখা সেরা ব্যাটিং ম্যাচটা এবং সিরিজটা জিতে নেয় বিশ্ব অবশিষ্ট দল।
এই দুটি সফরে গিয়ে সোবার্সের আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু তাকে চাপ দেওয়া হয় বোর্ডের তরফ থেকে এবং বলা হয় এই দুটি সফরের টেস্ট ম্যাচ গুলি সরকারি রেকর্ডে ধরা হবে, কিন্তু তা আদৌ হয়নি। সেই ইংল্যান্ড সফরে তার সঙ্গে এবি বালোর বন্ধুত্ব হয়। বার্লোর কথায় তিনি রোডেশিয়া তে একটা ডাবল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে রাজি হন। ফিরে এসে দেখলেন তাঁর রোডেশিয়া যাত্রা নিয়ে ত্রিনিদাদ, গিয়ানা, এমনকি বারবাদোসেও রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে। ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ভবিষ্যৎ(1979-71 যে বছর গাভাস্কার এর উত্থান ) নিয়েও সংশয় দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখতে হয় সোবার্সকে। তাহা গৃহীত হয় আর সফর নিয়েও সমস্যায় অবসান ঘটে। অবসর নেওয়ার পরেও সোবার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচের দায়িত্ব পান নি। কারণ তার নাকি কোচিং করানোর কোন সার্টিফিকেট নেই। সারা জীবন যিনি খেলে এসেছেন তিনি সার্টিফিকেট কোর্স করবেন কখন? তবে 1981 সালে শ্রীলংকার কোচ নির্বাচিত হন তখন সে সব প্রশ্ন ওঠেনি প্রায় তিন বছর শ্রীলংকার কোচিং এর দায়িত্বে ছিলেন এবং তখনই শ্রীলঙ্কা টেস্ট খেলতে আরম্ভ করেন। 1984 সালে যখন দেশে ফেরেন তখন বার্বাডোস ট্যুরিজম অথরিটি তাকে কনসালটেন্ট নিয়োগ করেন এবং কেবল ট্যুরিজম নয় সেইসঙ্গে স্কুলছাত্রদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট সংগঠিত করতেন। দু চারবার রেডিও-টিভিতে রিলে করবার ডাক পেয়েছিলেন তবে সে কাজ তার ভাল লাগেনি ক্রমশ তিনি গলফ খেলায় মন দিয়ে বিশেষ সাফল্য পান। সারাজীবনে অবশ্য সম্মান পেয়েছেন অজস্র। উইজডেনের ক্রিকেটার অফ দা ইয়ার, ‘ক্রিকেটার অফ দা সেঞ্চুরি’ রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে নাইটহুড পেয়েছেন । 1975 সালে এবং নিজের দেশ বার্বাডোসের ন্যাশনাল হিরো সম্মান আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বত্র এবং বিশ্বের সমস্ত ক্রিকেট মাঠে তিনি সবার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন।
তবে মাঠে এবং মাঠের বাইরে তিনি যে সবসময় সুবোধ বালক ছিলেন তা নয়। ব্যক্তিগত জীবনও খুব সুখের ছিল না প্রথমে চিত্রাভিনেত্রী অঞ্জু মহেন্দ্র সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে ভেঙে যায় পরে বিয়ে করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রু কাবিকে। তাদের দুটি ছেলে ও একটি দত্তক মেয়ে ছিল কিন্তু বিয়ে ভেঙে যায় অবশ্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মদ খাওয়া ঘোড়া দৌড় এর মাঠ এবং জুয়া খেলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল। প্রথম ভারত সফরে কানপুরে সারারাত মদ খেয়ে ভোরবেলা হোটেলে ঢুকে ম্যানেজার গাসস্ক্রিনের সামনে পড়ে যান ।কিন্তু পরের দিন সুভাষ গুপ্তের( প্রথম ইনিংসে 9 উইকেটে ) স্পিন সামলে অক্লেশে 198 করেন ও ম্যাচ জেতার ব্যবস্থা করেন। 1959 সালে কলি স্মিথের মৃত্যুর পর সমস্যাটা একটু বাড়ে। 1959-60 মরশুমে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ব্রিজটাউন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সারাদিন তিনি আর ওরেল ব্যাট করেন ট্রুম্যানের অগ্নিবর্ষী বোলিংয়ের সামনে। সারারাত নাইট ক্লাবে কাটিয়ে আবার পরের দিন অক্লেশে ব্যাটিং চালিয়ে যান। সে ম্যাচে
সোবার্স করেছিলেন 152 আর 95 এবং দুই ইনিংসে 68 ওভার বল করে 6 উইকেট নেন কিন্তু উইকেট টিকে থেকে ইংল্যান্ড ম্যাচ বাঁচিয়ে নেয়। আবার শেষ ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টে হাঁটুর চোট সমেত সোবার্স সারারাত মদ্যপানের পর দারুন মাথা ব্যথা নিয়ে কয়েকটা বল দেখতে পাননি । তারপর ব্যাটে বল লাগতেই আবার আগের মত।652-8 রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ডিক্লেয়ার করে সোবার্স 150 নট আউট। জু বার্নাড জুলিয়েন 121 ইংল্যান্ড হারে এক ইনিংস আর 226 রানে এগুলো কোনটাই প্রশংসার যোগ্য নয়। তবে সোবার্স অক্লেশে করেছিলেন কারণ তিনি পারতেন। কং ক্রিকেট বইতে লিখেছেন অফ স্টাম্পের বাইরে জোরে বল কে ডিপ স্কোয়ার লেগ বা ডিপ ফাইন লেগে মারার চেষ্টা করা উচিত নয় তবে আমি করি কারণ আমি গেরি সোবার্স। এখন একদিনের ম্যাচ বা টি-টোয়েন্টি দৌলতে এরকম শর্ট আমরা প্রায়ই দেখি কিন্তু তখন তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। শুধু ভাবি আজকের যুগে ওয়ানডে t20 তিনি কি করতেন।
অনে ক্রিকেটারই আত্মজীবনীমূলক কিছু লেখা লিখেছেন নয়তো দু-একটা সিরিজ এর বর্ণনা লিখেছেন। সোবার্স অবশ্য সহলেখক নিয়ে ছয় বই , আত্মজীবনী,সেরা ম্যাচের বর্ণনা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ইতিহাস , তাছাড়া ক্রিকেট নিয়ে আস্ত একটি উপন্যাস বনাভেঞ্চার এন্ড দা ব্লেড। এই আশ্চর্য ক্রিকেটকে সম্বন্ধে আপনাদের জেনে কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানান।